অভ্যুত্থানে স্বামী হারিয়েছেন এখন সন্তান নিয়ে উদ্বিগ্ন

সন্তান কোলে সাদিয়া খাতুন
নিজেস্ব প্রতিবেদক, ময়মনসিংহ
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫ | ০১:২৬
‘আমার স্বামী যখন ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন, তখন আমি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বর্তমানে ছয় মাসের মেয়েই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে মেয়ের নাম রাখা হয়েছে সাবরিনা বিনতে সিদ্দিক। আমার স্বামী দেশের মানুষের বৈষম্য দূর করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন, আমি ও আমার সন্তান যেন বৈষম্যের শিকার না হই।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে সমকালকে কথাগুলো বলছিলেন সাদিয়া খাতুন।
গত বছরের ২০ জুলাই ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন নূরে আলম সিদ্দিক। এ ঘটনার মাত্র ছয় মাস আগে ১২ জানুয়ারি তাদের বিয়ে হয়। নিজ বাড়ি গৌরীপুর উপজেলায় হলেও ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার কোনাপাড়া মাদ্রাসায় চাকরি করতেন সিদ্দিক। এই এলাকায় চাকরির সুবাদে বিয়ে করেন সাদিয়া খাতুনকে। স্বামীর স্মৃতি কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না তিনি।
সাদিয়া বলেন, সারাদেশে আন্দোলন যখন শুরু হচ্ছে, তার প্রথম দিন থেকেই সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল নূরে আলম সিদ্দিকীর। ১৮ ও ১৯ জুলাই আন্দোলনে যাওয়ার পর ভয় ঢুকে যায় মনে। এর ঠিক পরদিন গৌরীপুরের কলতাপাড়ায় আন্দোলনে অংশ নিলে পুলিশ সদস্যরা কাছ থেকে গুলি করে মেরে ফেলে তাঁকে। ওইদিন তাঁর সঙ্গে আরও দু’জন শহীদ হন।
স্বামী নিহত হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে চলে আসেন সাদিয়া। বাবার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। বাবা ও ভাই কোনো রকম উপার্জন করে চালিয়ে নিচ্ছেন। তাদের খোঁজখবর নেন না শ্বশুর-শাশুড়ি। সরকারি যা সহযোগিতা করা হয়েছে, তার অধিকাংশ টাকা তারা নিয়ে গেছেন বলে দাবি সাদিয়ার। তিনি বলেন, ‘সন্তান জন্মদানের জন্য আমি যখন হাসপাতালে ভর্তি, তখন জুলাই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা দেয় সরকার। আমি ভেবেছিলাম আমার শ্বশুরের কাছে সরকার সরাসরি টাকা দিলেও আমার সন্তানের জন্য কিছু টাকা দেবেন। পরে তারা আমাকে কিছুই দেননি।’
জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকেও আন্দোলনে নিহতদের অনেক আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ১ টাকাও পাননি বলে জানান সাদিয়া। তিনি বলেন, ‘আমি সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আজ যদি আমার স্বামী থাকত, তাহলে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ত না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এসব কথা শুনতে পেয়ে সাদিয়া খাতুনের পাশে দাঁড়ান। সর্বশেষ জেলা পরিষদ থেকে অনুদানের ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার চেক তুলে দেওয়া হয় তাঁর হাতে। সাদিয়ার দাবি, শহীদ পরিবারকে সঞ্চয়পত্রের ১০ লাখ টাকা যেন প্রকৃত ওয়ারিশ শনাক্ত করে বণ্টন করে দেওয়া হয়। এই টাকা যদি তাঁর সন্তান না পায়, তবে তাঁকে ভরণপোষণ করা কঠিন হয়ে যাবে।
সাদিয়ার ভাই মাহমুদুল হাসান শামীম বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করেন। নিজের সংসারের খরচ জোগানোর আগে স্বামীহারা বোনের কথা চিন্তা করেন তিনি। তাঁর ভাষ্য, সরকার যেন প্রতিটি শহীদের পরিবারের দায়িত্ব নেয়। প্রশাসনের প্রতি তাঁর আহ্বান, ‘যাদের কারণে আপনারা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছেন, তাদের যেন স্মরণে রাখেন।’
বিচার দেখে যেতে চান শহীদ বিপ্লবের বাবা
গৌরীপুরের কলতাপাড়া বাজারের বাসিন্দা বাবুল মিয়া। ২০ জুলাই বাড়ির পাশে আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে মারা যান তাঁর ছেলে বিপ্লব হাসান। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে আছেন তিনি। ছেলে হত্যার বিচার দেখে যাওয়াই তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা। উপজেলা সদরে ছোট একটি চাকরি করতেন বিপ্লব হাসান। ঘটনার দিন সকালে নাশতা খাওয়ার জন্য মায়ের কাছ থেকে ৫০ টাকা নিয়ে ঘর থেকে বের হন তিনি। এরপর ফেরেন লাশ হয়ে। পরে বাবুল মিয়া ছেলে হত্যার ঘটনায় ১১ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সদস্য সচিব মোহাম্মদ আল নূর আয়াশ জানান, জুলাই আন্দোলনে ময়মনসিংহ জেলার ৪১ জন বাসিন্দা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শহীদ হয়েছেন। সরকার এখন পর্যন্ত তাদের আশানুরূপ আর্থিক সহযোগিতা করতে পারেনি। শহীদ পরিবারের প্রতিটি সদস্য যাতে সচ্ছলভাবে চলতে পারেন, সে ব্যাপারে কাজ করছেন তারা।
- বিষয় :
- অভ্যুত্থান