বিলের দুই পাড় গিলে খাচ্ছে ভূমিদস্যুরা

জমি দখল করে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বড়বিলা জলমহালের দুই পাড়ে রাতারাতি গড়ে তোলা হচ্ছে মাছের বড় বড় ঘের সমকাল
কবীর উদ্দিন সরকার হারুন, ফুলবাড়িয়া (ময়মনসিংহ)
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১২:০০
'আমগোর মধ্যে মাইয়া পোলাপান খুব বেশি বড় হইতে দেয় না। যখন থেইকা এই বিলে সাঁতরাইছি, সিংড়া, পদ্ম তুলছি, তখনই পঞ্চায়েতের নজরে পড়ছি। মাতব্বর আইসা বাবার লগে কইলো মাইয়া বড় হইয়া গেছেগা। আমগো মধুপুরে ভালা একটা কর্মঠ পোলা আছে বিয়া দিয়া দেও। বাপমায় ১৩ বছরে বিয়া দেয় আমার মধুপুরের জলছত্র গেরামের কাঠুরি পিনুশ চাম্বুগংয়ের লগে। পরে স্বামী পোলাপান লইয়া আবারও এই বিল পাড়ে বাপের বাড়িতে উঠছি। কষ্টের কথা আর কি কমু, ছাগলের খোয়ারে জায়গা হয় আমার বাপের বাড়ি। সংসার চালানোর লাইগা জামাই-বউ মিলা ঝাঁপ দেই বড়বিলে। আমরা মাছ ধরি। শাপলা, শামুক, সিংড়া বেইচা, মাইনষ্যের জমিনে কামলা দিয়া কোনোমতে জীবন বাঁচাইছি।'
এভাবেই সমকালের কাছে বড়বিলার কথা বলছিলেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের হাতিলেইট গ্রামের ভিক্টোরিয়া গাবিল (৫০)। বলছিলেন, 'অহন যে যেমনে পাইছে বিলের জমি দখল কইরা নিতাছে। আগের হেই মাছও আর দেহি না। বিলের দখল লইয়া কত মারামারি, খুনাখুনি। জন্মের পরে বিলের পানিতে আমার প্রথম স্নান হইছে আর আমগরি বিলে জায়গা নাই, টেকা দিয়া মাছ ধরতে হয়। জল আর জাইলাগর নাই গো দাদা!'
ভিক্টোরিয়ার দেখা ময়মনসিংহের এই সবচেয়ে বড় জলমহাল বড়বিলা এখন ভূমিদস্যুদের খপ্পরে। তারা অবাধে মাছ চাষের অবৈধ ঘের নির্মাণ করায় এবং দুই পাশের জমি দখল নিয়ে ধানসহ মৌসুমি সবজি আবাদ করায় ছোট হয়ে আসছে এ বিল। উপজেলা ভূমি অফিসের তথ্যমতে সরকারি-বেসরকারিভাবে বড়বিলার আয়তন প্রায় ১২শ একর হলেও এখন বেশিরভাগ জমিই বেদখলে। বিলের জলও আর নেই জেলেদের নিয়ন্ত্রণে। বিলে জন্মানো দুর্লভ ভেষজ, জলজ উদ্ভিদসহ প্রাকৃতিক নৈসর্গও সম্পূর্ণ ধ্বংস হতে চলেছে তাদের কারণে।
স্থানীয় বাবুগঞ্জ মাঝিপাড়া, হাতিলের গ্রামের বিলপাড় এবং বর্মণপাড়াসহ কমপক্ষে এক হাজার মানুষ এই জলমহালে এখনও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। এ জন্য তাদের মাসিক চাঁদা দিয়ে ইজারাদারের কাছ থেকে মাছ ধরার অনুমতি নিতে হয়। বড়বিলার জেলে কেরামত আলী, কালাম, খলিল, নজরুল, নিজাম বলেন, 'আমরা বিলা ইচা (চিংড়ি) মাছ, গুরা গাছুরি (ছোটমাছ) ধইরা বাজারে বেচি, ইজারাদার আমগর কাছ থেইকা টেকা নেয়। কিন্তু কোনো রসিদ দেয় না।'
বিল পাড়ের আদি বাসিন্দা বর্মণপাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ পেরি মোহন বর্মণ, অর্জুন বর্মণ, মনেন্দ্র কোচ অভিযোগ করেন, 'আয়তনে বহুত বড় ছিল এই বিল। পানির সময় নদীর মতো দেখা গেছে। যার জমি আছিল এক কাঠা, সে জমি দখল করছে ১ পুরা (একর), বিলের মধ্য বান (ঘের) দিছে।'
চলতি অর্থবছরে ডিসি অফিসে টেন্ডারের মাধ্যমে ১৪ লাখ ৪৬ হাজার টাকা বছর চুক্তিতে স্থানীয় ইজারাদার সমর আলী 'আনুহাদি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি'র নামে বড়বিলা ইজারা পান। কিন্তু ভূমিখেকো প্রভাবশালীদের দাপটে তিনি নিজেই অসহায় হয়ে পড়েছেন বলে জানান সমর আলী।
জলমহালটির ব্যাপারে রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সালিনা চৌধুরী বলেন, প্রাকৃতিক এই বিলটি এলাকার ঐতিহ্য। এটা দখল হয়ে গেলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিলটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে, জেলা প্রশাসক এর অভিভাবক। আশা করি, তদন্ত করে তারা এমন সিদ্ধান্ত নেবেন, যা এলাকাবাসীর পক্ষে যাবে।'
সরেজমিন উপজেলার বড়বিল আর দুই পাড় ঘুরে দেখা যায়, জবরদখলের ভয়ানক চিত্র। ফাল্কগ্দুন-চৈত্র মাসে বিলের পানি কম থাকে। তখন দুই পাড়ের প্রভাবশালীরা অবাধে ধান আবাদ করেন। মাটি কাটার মেশিন দিয়ে নতুন নতুন ছোট-বড় মাছের ঘের নির্মাণ করেন। সম্প্রতি বিলে নতুন দুটি মাছের ঘের করেছেন প্রভাবশালীরা। এ সময় বাধা দিয়েও ঠেকাতে পারেননি বলে জানালেন ইজারাদার সমর আলী।
ফুলবাড়িয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কামরুন্নাহার শেফা বলেন, 'সরকার দখল হয়ে যাওয়া নদী, খাল-বিলের জায়গা উদ্ধারে বরাবরই তৎপর। যার কাছে বিল লিজ দেওয়া হয়েছে, সেই ইজারাদারই এখানে কেবল মাছ চাষাবাদ ও আহরণ করতে পারবেন। বেদখলের ব্যাপারে সার্ভেয়ার পাঠিয়ে দ্রুত খোঁজ নেওয়া হবে। যদি এমন ঘটে থাকে, তাহলে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
এর আগে ২০১৬ সালের জুন মাসে বড়বিলের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে এক সংঘর্ষে দু'জন নিহত হন, আহত হন বেশ কয়েকজন। এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে মামলা করে নিহতের পরিবার। এ মামলার সব আসামিই বর্তমানে জামিনে রয়েছে।
নিহত আব্দুল হালিমের মা লতিফা খাতুন অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে অভিযোগ করেন, 'আমার পোলা ভোরবেলা সকালে কয়ডা গুঁড়া মাছ ধরতে গেছিলো, এইটাই সহ্য হইলো না। চোখের সামনে, আমার বুক থেইকা ছিনাইয়া নিয়া আমার পোলারে কুবাইয়া মারছে। এর সুষ্ঠু বিচার আজও পাইলাম না। সব আসামি চোহের সামনে গুরতাছে অহন।' মামলাটি ময়মনসিংহ জেলা জজকোর্টে এখনও চলমান আছে বলে জানান নিহতের ছোট ভাই সেলিম রেজা।
স্থানীয় জেলেরা চান, বড়বিলা বিলকে দখলমুক্ত করে দেশি মাছ ও জেলেদের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হোক। স্থানীয় কৃষকরা চান, একে দখলমুক্ত করে আগের আয়তনে ফিরিয়ে আনা হোক। যাতে সেচকাজে এ বিলটি আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এলাকাবাসী জানান, বিলটি দখলমুক্ত হলে তা শুস্ক মৌসুমেও জনগণের উপকারে লাগবে। শীতকালে তা অতিথি পাখির নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে প্রাকৃতিক এ বিলকে সংরক্ষণের জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
এভাবেই সমকালের কাছে বড়বিলার কথা বলছিলেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের হাতিলেইট গ্রামের ভিক্টোরিয়া গাবিল (৫০)। বলছিলেন, 'অহন যে যেমনে পাইছে বিলের জমি দখল কইরা নিতাছে। আগের হেই মাছও আর দেহি না। বিলের দখল লইয়া কত মারামারি, খুনাখুনি। জন্মের পরে বিলের পানিতে আমার প্রথম স্নান হইছে আর আমগরি বিলে জায়গা নাই, টেকা দিয়া মাছ ধরতে হয়। জল আর জাইলাগর নাই গো দাদা!'
ভিক্টোরিয়ার দেখা ময়মনসিংহের এই সবচেয়ে বড় জলমহাল বড়বিলা এখন ভূমিদস্যুদের খপ্পরে। তারা অবাধে মাছ চাষের অবৈধ ঘের নির্মাণ করায় এবং দুই পাশের জমি দখল নিয়ে ধানসহ মৌসুমি সবজি আবাদ করায় ছোট হয়ে আসছে এ বিল। উপজেলা ভূমি অফিসের তথ্যমতে সরকারি-বেসরকারিভাবে বড়বিলার আয়তন প্রায় ১২শ একর হলেও এখন বেশিরভাগ জমিই বেদখলে। বিলের জলও আর নেই জেলেদের নিয়ন্ত্রণে। বিলে জন্মানো দুর্লভ ভেষজ, জলজ উদ্ভিদসহ প্রাকৃতিক নৈসর্গও সম্পূর্ণ ধ্বংস হতে চলেছে তাদের কারণে।
স্থানীয় বাবুগঞ্জ মাঝিপাড়া, হাতিলের গ্রামের বিলপাড় এবং বর্মণপাড়াসহ কমপক্ষে এক হাজার মানুষ এই জলমহালে এখনও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। এ জন্য তাদের মাসিক চাঁদা দিয়ে ইজারাদারের কাছ থেকে মাছ ধরার অনুমতি নিতে হয়। বড়বিলার জেলে কেরামত আলী, কালাম, খলিল, নজরুল, নিজাম বলেন, 'আমরা বিলা ইচা (চিংড়ি) মাছ, গুরা গাছুরি (ছোটমাছ) ধইরা বাজারে বেচি, ইজারাদার আমগর কাছ থেইকা টেকা নেয়। কিন্তু কোনো রসিদ দেয় না।'
বিল পাড়ের আদি বাসিন্দা বর্মণপাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ পেরি মোহন বর্মণ, অর্জুন বর্মণ, মনেন্দ্র কোচ অভিযোগ করেন, 'আয়তনে বহুত বড় ছিল এই বিল। পানির সময় নদীর মতো দেখা গেছে। যার জমি আছিল এক কাঠা, সে জমি দখল করছে ১ পুরা (একর), বিলের মধ্য বান (ঘের) দিছে।'
চলতি অর্থবছরে ডিসি অফিসে টেন্ডারের মাধ্যমে ১৪ লাখ ৪৬ হাজার টাকা বছর চুক্তিতে স্থানীয় ইজারাদার সমর আলী 'আনুহাদি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি'র নামে বড়বিলা ইজারা পান। কিন্তু ভূমিখেকো প্রভাবশালীদের দাপটে তিনি নিজেই অসহায় হয়ে পড়েছেন বলে জানান সমর আলী।
জলমহালটির ব্যাপারে রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সালিনা চৌধুরী বলেন, প্রাকৃতিক এই বিলটি এলাকার ঐতিহ্য। এটা দখল হয়ে গেলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিলটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে, জেলা প্রশাসক এর অভিভাবক। আশা করি, তদন্ত করে তারা এমন সিদ্ধান্ত নেবেন, যা এলাকাবাসীর পক্ষে যাবে।'
সরেজমিন উপজেলার বড়বিল আর দুই পাড় ঘুরে দেখা যায়, জবরদখলের ভয়ানক চিত্র। ফাল্কগ্দুন-চৈত্র মাসে বিলের পানি কম থাকে। তখন দুই পাড়ের প্রভাবশালীরা অবাধে ধান আবাদ করেন। মাটি কাটার মেশিন দিয়ে নতুন নতুন ছোট-বড় মাছের ঘের নির্মাণ করেন। সম্প্রতি বিলে নতুন দুটি মাছের ঘের করেছেন প্রভাবশালীরা। এ সময় বাধা দিয়েও ঠেকাতে পারেননি বলে জানালেন ইজারাদার সমর আলী।
ফুলবাড়িয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কামরুন্নাহার শেফা বলেন, 'সরকার দখল হয়ে যাওয়া নদী, খাল-বিলের জায়গা উদ্ধারে বরাবরই তৎপর। যার কাছে বিল লিজ দেওয়া হয়েছে, সেই ইজারাদারই এখানে কেবল মাছ চাষাবাদ ও আহরণ করতে পারবেন। বেদখলের ব্যাপারে সার্ভেয়ার পাঠিয়ে দ্রুত খোঁজ নেওয়া হবে। যদি এমন ঘটে থাকে, তাহলে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
এর আগে ২০১৬ সালের জুন মাসে বড়বিলের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে এক সংঘর্ষে দু'জন নিহত হন, আহত হন বেশ কয়েকজন। এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে মামলা করে নিহতের পরিবার। এ মামলার সব আসামিই বর্তমানে জামিনে রয়েছে।
নিহত আব্দুল হালিমের মা লতিফা খাতুন অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে অভিযোগ করেন, 'আমার পোলা ভোরবেলা সকালে কয়ডা গুঁড়া মাছ ধরতে গেছিলো, এইটাই সহ্য হইলো না। চোখের সামনে, আমার বুক থেইকা ছিনাইয়া নিয়া আমার পোলারে কুবাইয়া মারছে। এর সুষ্ঠু বিচার আজও পাইলাম না। সব আসামি চোহের সামনে গুরতাছে অহন।' মামলাটি ময়মনসিংহ জেলা জজকোর্টে এখনও চলমান আছে বলে জানান নিহতের ছোট ভাই সেলিম রেজা।
স্থানীয় জেলেরা চান, বড়বিলা বিলকে দখলমুক্ত করে দেশি মাছ ও জেলেদের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হোক। স্থানীয় কৃষকরা চান, একে দখলমুক্ত করে আগের আয়তনে ফিরিয়ে আনা হোক। যাতে সেচকাজে এ বিলটি আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এলাকাবাসী জানান, বিলটি দখলমুক্ত হলে তা শুস্ক মৌসুমেও জনগণের উপকারে লাগবে। শীতকালে তা অতিথি পাখির নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে প্রাকৃতিক এ বিলকে সংরক্ষণের জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
- বিষয় :
- ভূমিদস্যু