সেই জাহাজটি ডাকাতিয়া নদীর পাশে সংরক্ষণের দাবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মারকলিপি

চাঁদপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২০ | ০৬:৪৩
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন পাক হানাদার বাহিনীর জাহাজ ‘এমভি ইকরাম’ চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীর পাশে সংরক্ষণের দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছে ঢাকাস্থ চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ। সোমবার সকালে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাজেদুর রহমানের কাছে এ স্মারকলিপি প্রদান করেন তারা।
ঢাকাস্থ চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের সভাপতি মিঞা মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ উল্লাহ রতনের স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি তথা আবেদনটি জেলা প্রশাসকের কাছে তুলে দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চাঁদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহম্মদ শফিকুর রহমান, জাহাজটি ডুবানোর নেতৃত্বদানকারী নৌ কমান্ডো সাবেক সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা মমিন উল্যাহ পাটওয়ারী বীর প্রতীক এবং জাহাজ সংরক্ষণ কমিটির সদস্য এবং জাহাজ ডুবানো দলের অন্যতম শাহজাহান কবির বীর প্রতীকসহ অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা।
এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৌ কমান্ডো বাহিনী মধ্য আগস্ট থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম-মংলা সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ নৌ বন্দরসহ বাংলাদেশের সমগ্র জলপথে লিমপেট মাইনের সাহায্যে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর রসদ ও অস্ত্রসস্ত্র বহনকারী ১২৬টি জাহাজ গভীর পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে সমগ্র জলপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে হানাদার বাহিনীর জলপথ বন্ধ করে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৩০ অক্টোবর গভীর রাতে সাবমেরিনার শেখ আমানউল্লা বীর বিক্রমের অধিনে চাঁদপুর নৌ কমান্ডোরা লিমপেট মাইনের সাহায্যে ডাকাতিয়া নদীর লন্ডনঘাটে পাক বাহিনীর এই জাহাজ এমভি ইকরাম (এমভি লোরাম) জাহাজটি গভীর পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে নদীবন্দরকে অচল করে। তারপর থেকে পাক বাহিনী কুমিল্লা, নোয়াখালি, বরিশাল, ফরিদপুর অঞ্চলে অচল হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার আগে পাক সেনারা এটি তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারও এটি ওঠাতে চেষ্টা করে এবং নিলামে তোলে। পরে মোক্তার হোসেন এন্ড রফিকুল ইসলাম নিলামের মাধ্যমে পানির তলে থাকা জাহাজটি কিনে নিয়ে উত্তোলন করে।
তারা বলেন, ২০০৮ সালে উত্তোলণের পরপরই এটি চাঁদপুরেই সংরক্ষণের জন্য আমরা মুক্তিযোদ্ধা ও চাঁদপুরবাসী দাবি ও আন্দোলন করি। পরে সেটি চুরি করে নারায়ণগঞ্জের এক ডকইয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সরকার এটিকে তাদের করায়ত্বে আনলেও গত এক যুগে সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গেল তত্ত্বাবধায়ক সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে জাহাজটিকে সংরক্ষণের জন্য জব্দ করে নারায়ণগঞ্জের একটি ডকইয়ার্ডে রাখে।
মুক্তিযোদ্ধারা আরও বলেন, এমভি আকরাম (লোরাম) চাঁদপুরে সংরক্ষণের দাবি হয়। পরে ২০১৮ সালে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে জাহাজ উত্তোলনকৃত মালিকের অর্থ পরিশোধ ও জাহাজটি সংরক্ষণের জন্য ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। বরাদ্দের অর্থ থেকে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে ১ কোটি ৯ লাখ ৫ হাজার টাকা মেসার্স মোক্তার হোসেন এন্ড রফিকুল ইসলাম ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটিকে প্রদান করতে এবং বাকী ৯০ লাখ ৯৫ হাজার টাকা জাহাজটি সংরক্ষণে ব্যয়ের জন্য বিআইডাব্লিটিএর নিকট গচ্ছিত রাখে। সবশেষ গত ১৮ নভেম্বর দুপুরে এই জাহাজ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর, সংরক্ষণের জন্য প্লাটফর্ম সেড নির্মাণের সম্ভাব্য স্থান পরিদর্শন সংক্রান্ত কমিটির প্রথম সভা হয় নারায়ণগঞ্জে। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন সাবেক নৌ পরিবহন মন্ত্রী মো. শাহজাহান খান। সেখানে উপস্থিত সভায় জাহাজটি সংরক্ষণের জন্য ঢাকাতে কোন স্থান না পাওয়ায় নদীবন্দর এলাকা চাঁদপুর এবং মাদারীপুরে সংরক্ষণের জন্য একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়। এ অবস্থায় ঢাকাস্থ চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের নেতৃবৃন্দের দাবি- জরুরী ভিত্তিতে জাহাজটি নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর এনে ডাকাতিয়া নদীপাড়ে সংরক্ষণ করে এটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক এবং যেন মুজিববর্ষ উপলক্ষে আগামী ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে যেন এটি করা হয়।
এ সময় চাঁদপুর-৪ আসনের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, আমি চাঁদপুরের সন্তান হিসেবে, পাশাপাশি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের এই জোরালো দাবির সাথে একাত্মতা পোষণ করে বলছি- এটি চাঁদপুরেই সংরক্ষণ যাতে হয় সেই ব্যবস্থাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা কমিটি করবেন- এই দাবি রাখছি।
এ সময় জেলা প্রশাসক তাদের আবেদন সম্বলিত স্মারকলিপিটি পাওয়ার পর বলেন, আপনাদের এই যৌক্তিক দাবির সাথে জোর সমর্থন রেখে আমিও চেষ্টা অব্যাহত রাখবো যেন এটি চাঁদপুরেই এটি সংরক্ষণ করা হয়। তিনি বলেন, আজই আমি এটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ অন্যদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার দৈনিক সমকালে ‘সেই জাহাজটি চাঁদপুরেই সংরক্ষণের দাবি মুক্তিযোদ্ধাদের’ এই শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।