কারাগারে বন্দির নারীসঙ্গ, ডেপুটি জেলারসহ ৩ জনকে প্রত্যাহার

ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি
সমকাল প্রতিবেদক ও গাজীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২১ | ০৯:৪৪ | আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২১ | ১১:৩৩
করোনাকালে দেশের সব কারাগারে দর্শনার্থী প্রবেশে এক ধরনের বিধিনিষেধ রয়েছে। এরপরও জরুরি কোনো কারণে কোনো কারাবন্দির সঙ্গে কারাগারে তার স্বজনের সাক্ষাতের প্রয়োজন হলে কারা অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু অধিদপ্তরকে অবহিত না করেই গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার-১-এ একজন কয়েদির সঙ্গে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন এক নারী।
ওই বন্দির নাম তুষার আহমেদ। তিনি হলমার্কের জিএম ছিলেন। তুষার হলমার্ক কেলেঙ্কারির মূলহোতা তানভীর মাহমুদের ভায়রা।
সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, কারাগারে গিয়ে তুষারের সঙ্গে এক নারী অন্তরঙ্গভাবে মিশছেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই নারীর নাম আসমা শেখ। তিনি তুষারের স্ত্রী। আসমার গ্রামের বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়ায়। বর্তমানে ঢাকার সবুজবাগে বসবাস করছেন। আসমার মায়ের নাম মোসাম্মৎ রিনা ও বাবা মুসা আহমেদ।
কারাগার অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন সমকালকে বলেন, এ ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরইমধ্যে তিনজনকে প্রত্যাহার করে কারা অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়।
কারাগারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, ৬ জানুয়ারি বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ওই নারী কারাগারের ভেতর ঢোকেন। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বেরিয়ে যান। সিসি ক্যামেরায় পুরো সময়টা ধরা পড়েনি। এরমধ্যে রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। একটি অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে তিনি কারাফটকে আসার পর ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইন ও সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায় ওই নারীকে অন্য কর্মচারীদের সামনেই গ্রহণ করেন। এর জন্য মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছে বলেও সূত্রটি জানিয়েছে। তুষার আহমেদের সঙ্গে অপরিচিত ওই নারী অন্তরঙ্গ ছাড়াও নানা ভঙ্গিতে বেশ কিছু সময় কাটান কারা ফটকের ভেতরে। এটা কীভাবে সম্ভব এমন প্রশ্ন সচেতন মহলের। এ ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরপরই কারা কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এছাড়া জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবুল কালামকে প্রধান করে পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন গত ১২ জানুয়ারি। ইতোমধ্যে সেই ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইন ও সার্জেন্ট প্রশিক্ষক আবদুল বারীসহ তিনজনকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
তুষার আহমেদ এবং ওই নারীর সামনে থাকা সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায়ের সঙ্গে পুরো বিষয়টি নিয়ে বারবার কথা বলার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি মুখ খোলেননি।
রত্না রায় সমকালকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে যেহেতু উচ্চপর্যায়ের দুটি তদন্ত চলছে, সুতরাং এ মুহূর্তে তিনি এ সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন না।
জেলা প্রশাসকের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবুল কালাম বলেন, এ সপ্তাহেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। প্রাথমিকভাবে এটুকু বলা যায়, কয়েদির সঙ্গে একজন নারী দেখা করেছেন। সেটা সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।
ভাইরাল হওয়া সিসি ক্যামেরার ওই ভিডিওতে দেখা যায়, অন্য দুই যুবকের সঙ্গে ওই নারী করাফটক পেরিয়ে অফিস কক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সময় তখন দুপুর ১২টা ৫৬ মিনিট। এর পর কাশিমপুর কারাগার-১-এর ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইন ও সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায় ওই নারীকে গ্রহণ করছেন। ওই নারীর গায়ে বেগুনি রঙের সালোয়ার-কামিজ ও মুখে মাস্ক পরা।
অনেকটা সাহেবি ভক্তিতে কালো টি-শার্ট ও কালো রঙের প্যান্ট পরা তুষার কারাগার থেকে ফটকের কাছে বাম পাশের একটি কক্ষে ঢুকে পড়েন। ভিডিওতে দেখা যায়, ওই নারীও ঢুকে পড়েন পাশের কক্ষে। বেরিয়ে যান সাকলায়েন। আট মিনিট পর ফেরেন তুষারকে নিয়ে। ১০ মিনিট পর অফিস ছাড়েন, বেরিয়ে যান সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায়। কিছু সময় তারা দু'জন ওই কক্ষে কাটানোর পর বেরিয়ে আসেন। কারাগারের কর্মচারী ও নিরাপত্তা কর্মীদের সেখানে দেখা যায়। দু’জন হেঁটে বের হওয়ার সময় তুষার ওই নারীকে একবার প্রকাশ্যে জড়িয়েও ধরেন। এর পর আবার ওই কক্ষে ঢুকে পড়েন দু’জন। কড়া নিরাপত্তা বাইরে। সময় কাটান পৌনে এক ঘণ্টা। কারাগারের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, এটা সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। শুধু এ অংশই নয়, অনেক কিছুই ধরা পড়েনি। সাড়ে ১২টার দিকে ওই নারী ঢোকেন করাগারে, বেরিয়ে যান সাড়ে ৫টার দিকে- এমন তথ্য দিয়েছেন করাগারের একাধিক কর্তা। করাগারের ভেতরে এমন তুঘলকি কাণ্ড দেখে হতবাক অনেকেই। কারাগারে কর্মরত কর্তারাই বলছেন, এটা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময় ছাড়া সম্ভব হয়নি। দোষী যেই হোক, তার শাস্তি চাচ্ছেন সহকর্মীরা।
গাজীপুর জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর দোষী কর্মকর্তাদের শাস্তির জন্য সংশ্নিষ্ট বিভাগে সুপারিশ করা হবে। ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তদন্ত কমিটির সদস্যরা দফায় দফায় কারাগার পরিদর্শন করেছেন, কথা বলেছেন সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সে সময় দায়িত্বে থাকা তিনজনকে কারা কর্তৃপক্ষ প্রত্যাহার করে নিয়েছে।