কোনো বাধা মানবো না
যন্ত্রের পায়ে ছুটে স্বপ্ন বুনছেন পলাশ

শারীরিক প্রতিবন্ধী জাহিদুল ইসলাম পলাশ - সমকাল
সৌরভ হাবিব, রাজশাহী
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১৫:৫২
অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে কোনো প্রতিবন্ধকতাই যে মানুষকে আটকাতে পারে না, পলাশ তারই ছবি। স্বপ্নবাজ এই তরুণ নিজের সীমাবদ্ধতাকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেননি। এখানেই অন্যদের কাছে উদাহরণ তিনি। স্বাভাবিক মানুষের মতো পলাশের পা জোড়া পথের পর পথ মাড়িয়ে বেড়াতে পারছে না ঠিকই; কিন্তু তার ছুটে চলা থেমে নেই! যন্ত্রের পায়ে ভর করে ছুটছেন তিনি, বুনছেন স্বপ্ন।
গল্পের পলাশের বাড়ি রাজশাহী নগরীর ধরমপুর পশ্চিমপাড়ায়। শিশুকালে একদিন হঠাৎ বিভীষিকা নেমে আসে তার জীবনে। বৈদ্যুতিক তার গায়ে পড়ে তখন একটি পা হারান পলাশ। এর পর থেকেই হুইলচেয়ারে চলাফেরা। বর্তমানে তিনি অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফুডপান্ডার খাবার ডেলিভারির 'রাইডার' হিসেবে চাকরি নিয়েছেন। ব্যাটারিচালিত হুইলচেয়ারেই ছুটে চলেন দুয়ারে দুয়ারে।
দিনমজুর নাজির আলীর তিন ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় জাহিদুল ইসলাম পলাশ (২২)। মা জানেহার বেগম গৃহিণী। বড় ভাই ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, বিয়ে করে আলাদা থাকেন। ছোট ভাই এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। পলাশ ২০১৭ সালে বিএম শাখা থেকে জিপিএ ৪.১৬ নিয়ে এসএসসি এবং ২০১৯ সালে জিপিএ ৩.৯৬ পেয়ে এইচএসসি পাস করেছেন।
জানা গেছে, আর দশজনের মতোই স্বাভাবিক মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন পলাশ। ছুটে বেড়াতেন, খেলতেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার দুরন্ত জীবনে নেমে আসে বিভীষিকা। ২০১০ সালের শেষের দিকের ঘটনা। পলাশ তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। একদিন নগরীর কাজলায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ তার গায়ের ওপর বৈদ্যুতিক তার খসে পড়ে। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফেরার পরে নিজেকে আবিস্কার করেন ঢাকার একটি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। বাঁ পায়ের হাড় ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে হাঁটুর নিচ থেকে বাঁ পা কেটে ফেলতে হয়। দুর্ঘটনায় ডান পাও অকেজো হয়ে যাওয়ায় হুইলচেয়ারকে সঙ্গী করতে হয় তার।
পলাশ জানান, হুইলচেয়ারে চলাফেরা করলেও করুণার পাত্র হতে চান না। চান না কারও কাছে হাত পাততে। তাই তিনি খাবার ডেলিভারির চাকরি নিয়েছেন। নিজের ব্যাটারিচালিত হুইলচেয়ারে ছুটে বেড়ান নগরীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। পাশাপাশি তিনি পড়ালেখা করছেন। করোনার কারণে শিক্ষাপ্র্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, এখন শিখছেন ওয়েব ডিজাইনের কাজ। ভবিষ্যতে ওয়েব ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এ ছাড়াও প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে সংগঠন দাঁড় করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি জানান, চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে খাবার ডেলিভারির কাজে যোগ দেন। লেখাপড়ার বাইরে ফাঁকা সময়ে তিনি এ কাজ করেন। নির্ধারিত এলাকার ২০০-৫০০ ফুটের মধ্যে প্রতিটি ডেলিভারির জন্য পান ২২ টাকা। এর বাইরে যেতে হলে দূরত্বের ওপর ভিত্তি করে পান আলাদা হাজিরা। এভাবে ডেলিভারিপ্রতি ২২-৩০ টাকা পর্যন্ত পান।
পলাশ বলেন, '২০১৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে না হলেও সরকারি কলেজে পড়তে চাই। এজন্য ভবিষ্যতের চিন্তা করে টাকা জমাচ্ছি। তা ছাড়া নিজের খরচের জন্য বাবা বা কারও ওপর নির্ভর করে থাকাটা আমার পছন্দ নয়। বাবার আয় দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে, তাদের বাড়তি চাপ দিতে চাই না। নিজে স্বাবলম্বী হতে চাই।'
সুখী-সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন পলাশ। যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ। তিনি জানান, প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে চান। এজন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন 'আশার আলো প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংগঠন'। এরই মধ্যে সংগঠনে যুক্ত হয়েছেন ৬০ জন প্রতিবন্ধী।
পলাশ বলেন, 'নিজ উদ্যোগে সংগঠনটি চালাচ্ছি। সরকারি সহযোগিতার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরে যোগাযোগও করেছি।' ক্রীড়া ক্ষেত্রেও দক্ষতা রয়েছে পলাশের। বাংলাদেশ হুইলচেয়ার স্পোর্টস ফাউন্ডেশনের নিবন্ধিত খেলোয়াড় তিনি। ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ২০১৯ সালে জাতীয় ডার্ট প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নও হয়েছেন।
তিনি বলেন, একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কৃষিকাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের নেতৃত্বের জায়গাতেও অবদান রাখতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস। তাদের অবহেলা না করে এগিয়ে নিতে পারলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব।