'সবুজ প্রকল্পে' হুমকিতে সবুজ

আশুগঞ্জে পানির অভাবে নষ্ট হচ্ছে ক্ষেতের ফসল- সমকাল
আবদুন নূর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আনোয়ার হোসেন, আশুগঞ্জ
প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১৫:২৬
কৃষি ও কৃষকবান্ধব হিসেবে প্রচারিত আশুগঞ্জ-পলাশ এগ্রো-ইরিগেশন সেচ প্রকল্পটি স্থানীয়ভাবে 'সবুজ প্রকল্প' নামে পরিচিত। অথচ এ প্রকল্পের কারণেই হুমকির মুখে পড়েছে সবুজ। এ প্রকল্পে সেচের পানির জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া অংশে কৃষকের মাঝে হাহাকার চলছে। এক মাস আগে পানি ছাড়া হলেও এখনও অনেক এলাকায় না পৌঁছায় কয়েক হাজার একর জমি অনাবাদি থাকার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আবার যেসব জমিতে ধান রোপণ করা হয়েছে, সেসব জমিতেও পানির অভাবে ধানের চারা মরে যাচ্ছে।
প্রকল্পটির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় কৃষকের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন সেচ সুবিধা ও প্রকল্প সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে 'কৃষক সমিতি'র ব্যানারে চলছে সভা-সমাবেশ।
চলমান সেচ প্রকল্পের কুলিং রিজার্ভার পুকুর ও মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ কাজে সেচ খাল-ড্রেন ভরাট ও ভেঙে ফেলায় স্বাভাবিক সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে- এমন দাবি কৃষক ও সংশ্নিষ্টদের। সেচ কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হওয়ার কথা স্বীকার করে এসব সমস্যা সমাধানে সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) কর্তৃপক্ষ।
কৃষক ও সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, বোরো মৌসুমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর, আশুগঞ্জ, সরাইল ও নবীনগর উপজেলার প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান ও প্রায় ৭০ হাজার টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যে চলতি বছর ১৫ জানুয়ারি সেচের পানি ছাড়া হয়। কিন্তু এক মাসেও জেলার সরাইল উপজেলার বুল্লাবাড়ি, নোয়াহাটি, দেওবাড়িয়া, কাবিতারা, পানিশ্বর, কালিকচ্ছ, চুন্টা, নোয়াগাঁও এবং শাহবাজপুর এলাকায় এখনও পানি পৌঁছায়নি। কয়েকটি এলাকায় পানি পৌঁছলেও তা খুবই কম।
এদিকে নিরবচ্ছিন্ন সেচ প্রদান ও প্রকল্পের সেচের পানি নিয়ে তৈরি হওয়া সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে জেলা-উপজেলায় 'সেচ প্রকল্প রক্ষা' কমিটি গঠিত হয়েছে। জেলা-উপজেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান ও সমাবেশ করছেন কৃষকরা।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অনেক এলাকায় চারা রোপণের ১৫ দিন পেরিয়ে গেলেও সেচ দিতে না পারায় চারা শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। আবার বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষক জমি প্রস্তুত করে বসে থাকলেও এসব এলাকায় এখনও পানি যায়নি। এসব জমিতে বোরো আবাদ করতে পারবেন কিনা এ নিয়েও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন শত শত কৃষক।
জানা যায়, আশুগঞ্জের রেলগেট এলাকায় বিদ্যুৎ বিভাগের পুকুরকে বিএডিসি কর্তৃপক্ষ এ সেচ প্রকল্পের প্রধান কুলিং রিজার্ভার হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। গত বছর অফিস নির্মাণের জন্য এ পুকুরের প্রায় ৭৫ ভাগ ভরাট করে ফেলে বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ। ফলে রিজার্ভার পুকুরের আয়তন কমে যাওয়ায় পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। এদিকে আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের কাজে মহাসড়কের পাশে প্রায় ১১ কিলোমিটার ড্রেন, খাল ভরাট ও ভেঙে ফেলা হয়েছে। অন্যান্য বছর প্রায় ৩০-৪০ ফুট প্রশস্ত ড্রেন-খাল দিয়ে সেচের পানি প্রবাহিত হলেও বর্তমানে তা কমে গিয়ে কোনো কোনো স্থানে ৪-৫ ফুট নালায় পরিণত হয়েছে। এ ছোট নালাও পানির চাপে বালু দিয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে বিস্তীর্ণ এলাকায় চাহিদা মতো পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কথা স্বীকার করে তা সমাধানে সরকার স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে বিএডিসি ব্রাহ্মণবাড়িয়া (ক্ষুদ্র সেচ) বিভাগ।
প্রকল্পের পানিশ্বর ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামের বোয়ালিয়া খাল-সংলগ্ন স্কিমের স্কিম ম্যানেজার বাচ্চু মিয়া জানান, পানির বিলম্ব দেখে তার স্কিমের অনেক কৃষক ভূগর্ভস্থ পানি (অগভীর নলকূপ) দিয়ে জমি রোপণ করে ফেলেছেন।
পানিশ্বর ইউনিয়নের টিঘর গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম পার্শ্ববর্তী বুল্লাবাড়ি, নোয়াহাটি, দেওবাড়িয়া, কাবিতারার বিস্তীর্ণ এলাকা দেখিয়ে বলেন, পানিশ্বর, কালিকচ্ছ এবং চুন্টা ইউনিয়নের প্রায় তিন হাজার বিঘা জমি এখনও অনাবাদি। এসব জমি আদৌ আবাদ হবে কিনা তা অনিশ্চিত। একইভাবে নোয়াগাঁও এবং শাহবাজপুর ইউনিয়নের শত শত বিঘা জমি পানির অভাবে এখনও রোপণ করতে পারেননি কৃষকরা।
টিঘর এলাকার স্কিম ম্যানেজার শহীদুল্লাহ জানান, তার স্কিমের মাত্র ১৫-২০ বিঘা জমি রোপণের পর আর পানি পাননি। ফলে পানির জন্য তিনি কৃষকদের দিক থেকে খুব চাপে রয়েছেন বলে জানান।
এ প্রকল্পে বিগত বছরগুলোতে কৃষকরা একরপ্রতি গড়ে ৪-৫শ টাকায় নিরবচ্ছিন্ন সেচ সুবিধা পেয়ে আসছিলেন।
আশুগঞ্জ সবুজ প্রকল্প রক্ষা কমিটির উপজেলা শাখার সদস্য সচিব ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক শাহীন সিকদার বলেন, পিডিবি প্রধান রিজার্ভার পুকুরটি ভরাট করে ফেলায় এবং রাস্তার পাশের খাল সংকুচিত হয়ে পড়ায় আগের গতিতে পানি ছাড়া যাচ্ছে না। ফলে শত শত কৃষক চাহিদা মতো পানি পাচ্ছেন না।
আশুগঞ্জ সবুজ প্রকল্প রক্ষা কমিটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক হোসাইন আহমেদ তফছির প্রকল্পটির বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ও টেকসই অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি প্রকল্প এলাকা সম্প্রসারণেরও দাবি জানান।
এ ব্যাপারে বিএডিসি (ক্ষুদ্র সেচ) বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী খলিলুর রহমান সমকালকে বলেন, চলতি বছর সেচে কিছুটা সমস্যা তো হচ্ছেই। আমরা স্থানীয় কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে রেশনিং পদ্ধতিতে সেচ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি।
প্রকল্পটির পিডি ও বিএডিসির ব্রাহ্মণবাড়িয়া অফিসের সদ্য বিদায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী ওবায়দুর রহমানও চলতি মৌসুমে সেচ প্রকল্পে পানি নিয়ে কিছু সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে বিএডিসি সার্বক্ষণিকভাবে সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। সরকার এ সেচ প্রকল্পের স্থায়ী সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হাতে নিয়েছে।