সিনহা হত্যা মামলার রায়
প্রদীপ-লিয়াকতের ফাঁসি

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলার রায় ঘোষণার পর লিয়াকত ও প্রদীপকে এভাবেই আদালত থেকে জেলহাজতে নেওয়া হয়- সমকাল
সাহাদাত হোসেন পরশ, ঢাকা আবু তাহের, কক্সবাজার ও আবদুর রহমান, টেকনাফ
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২২ | ২০:৪০
সাগর, পাহাড় মিলে নৈসর্গিক এলাকা কক্সবাজার। মাদক চোরাচালান ও 'বন্দুকযুদ্ধে'র কারণেও বারবার আলোচনায় আসে এলাকাটির নাম। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজার-টেকনাফের মেরিন ড্রাইভে চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। দেড় বছরের মাথায় গতকাল সোমবার বহুল আলোচিত ওই ঘটনার মামলায় রায় ঘোষণা করা হলো। এতে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছেন আদালত।
গতকাল সোমবার বিকেলে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এই রায় ঘোষণা করেন। পুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তার ফাঁসির দণ্ড হওয়ার নজির এটিই প্রথম। রায়ে ৬ জনের যাবজ্জীবন সাজা হয়। তারা হলেন- টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, এপিবিএনের কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা; মারিশবুনিয়া গ্রামের তিন ব্যক্তি নেজাম উদ্দিন, নুরুল আমিন ও মো. আইয়াজকে যাবজ্জীবন কারাদ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এই ছয়জনকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদে র আদেশ দেন আদালত।
এ ছাড়া ৭ জন বেকসুর খালাস পেয়েছেন। তারা হলেন- বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের এএসআই মো. লিটন মিয়া, টেকনাফ থানার কনস্টেবল ছাফানুল করিম, মো. কামাল হোসাইন আজাদ, মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য এসআই মো. শাহজাহান আলী, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ও কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন।
গতকাল ৩০০ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান বিচারক। তিনি বলেন, 'ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে। তাতে আট আসামির সংশ্নিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।'
রায় ঘোষণার সময় ধূসর জ্যাকেট পরে কাঠগড়ায় থাকা প্রদীপ এবং তার পাশে থাকা লিয়াকত ছিলেন নির্বিকার। তবে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া ছয় আসামির মধ্যে কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন। কয়েকজন উচ্চস্বরে প্রতিবাদ জানান।
রায় ঘোষণার পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সিনহার বোন ও মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। শুরু থেকে বলে এসেছি যাতে প্রধান দুই আসামির সর্বোচ্চ সাজা হয়। সেটা হয়েছে। তবে সাতজন খালাস পাওয়ায় পুরোপুরি খুশি হতে পারিনি।
সরকারি কৌঁসুলি ফরিদুল আলম বলেন, ৩১ কার্য দিবসে ৬৫ জনের সাক্ষ্য নিয়েছি। এতে উঠে আসে ওসি প্রদীপের নেতৃত্বে আসামিরা সিনহাকে হত্যা করেন। আশা করেছিলাম, আজকে সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।
রায়ের পর প্রদীপের আইনজীবী মহিউদ্দিন খান বলেন, আমরা রায়ের কপি পাওয়ার পর উচ্চ আদালতে যাব। পরিদর্শক লিয়াকত আলীর আইনজীবী চন্দন দাস বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করব।
কড়া নিরাপত্তা: রায় ঘিরে গতকাল সকাল থেকেই কক্সবাজার আদালত প্রাঙ্গণে ছিল কড়া নিরাপত্তা। আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সংশ্নিষ্ট সকলকে প্রধান ফটক থেকে শুরু করে এজলাস পর্যন্ত যেতে কয়েক দফা নিরাপত্তা বাহিনীর বলয় পার হতে হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করে ওসি প্রদীপের মৃত্যুদণ্ড দাবি করেন 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত অনেকের স্বজনরা। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়।
বেলা ২টার দিকে প্রিজন ভ্যানে করে আসামিদের আদালতে নিয়ে আসা হয়। ২টা ১৬ মিনিটে বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। এ সময় পুরো মামলায় আসামি, বাদী ও সাক্ষীদের বক্তব্য উঠে আসা ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন বিচারক। প্রদীপ, লিয়াকতসহ সাজাপ্রাপ্ত আসামি কার কী অপরাধ তা তুলে ধরে তিনি। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সাজা ঘোষণা করেন বিচারক।
কনস্টেবল রুবেল শর্মার স্ত্রী সকাল থেকে উপস্থিত ছিলেন আদালতে। রায় ঘোষণার পর তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। একপর্যায়ে দায়রা জজ আদালতের পাশে থাকা আইনজীবীদের বিশ্রামাগারে অবস্থান নিতে দেখা যায় তাকে।
'আমরা কী করেছি':যাবজ্জীবন পাওয়া ছয়জনের মধ্যে তিন আসামি নুরুল আমিন, নেজামুদ্দিন ও আয়াজউদ্দিন মারিশবুনিয়ার বাসিন্দা, তারা কেউ পুলিশের সদস্য নন। রায় ঘোষণার পর প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় তারা চিৎকার করে আঞ্চলিক ভাষায় বলছিলেন- 'পুলিশে গুলি গইজ্জে, আঁরা কি গইজ্জ্বি? (পুলিশ গুলি করেছে, আমরা কী করেছি)'।
সোমবার রায় পড়ার সময় বিচারক বলেন, প্রদীপ ঘটনার দিন তার সোর্সদের সিনহার বিষয়ে বিস্তারিত বলেছিলেন। তাদের ৫ লাখ টাকা করে দেওয়ার লোভও দেখান প্রদীপ। টাকার লোভে মসজিদের মাইক দিয়ে পাহাড়ে 'ডাকাত' পড়েছে বলে ঘোষণা দেয় তারা। এই তিনজন পুলিশের সোর্স হিসেবে সিনহা হত্যা মামলায় প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা পালন করেছেন।
জলিলের স্ত্রীর আহাজারি: বিভিন্ন সময় বন্দুকযুদ্ধে নিহত অনেকেরই স্বজন আদালত চত্বরে আসেন। 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত জলিলের স্ত্রী ছেনুয়ারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'আমার স্বামীকে আটকের পর থানায় ৮ মাস নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। আমার স্বামী এমন কী অপরাধ করেছিলেন, তাকে এমনভাবে গুলি করে মারতে হয়েছে? সে সিএনজিচালক ছিলেন। আমি প্রদীপের ফাঁসির রায় দ্রুত বাস্তবায়ন চাই।'
'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত জলিলের ভাই আবদুর রশিদ বলেন, 'সারা দিন আদালত এলাকায় সবাই বসে ছিলাম। আমরা খুব খুশি। যারা আসল অপরাধী, তারা মুক্তি পেলে অনেক কষ্ট পেতাম।' ইউপি সদস্য হাম জালাল বলেন, 'নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালতে বহাল রাখার দাবি জানাচ্ছি। প্রদীপ অনেক মায়ের বুক খালি করেছে।'
ঘটনাক্রম: ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা। সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার পর 'লেটস গো' নামে একটি ভ্রমণবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র বানানোর জন্য প্রায় এক মাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় অবস্থান করছিলেন তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ।
চেকপোস্টে গুলিতে সিনহাকে হত্যার পর পুলিশ দাবি করেছিল, 'সিনহা তল্লাশিতে বাধা দেন। তিনি পিস্তল বের করলে চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে।' এসব বিষয় উল্লেখ করে এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় একমাত্র আসামি করা হয় সিনহার সঙ্গী সিফাতকে। ওই মামলায় সিফাতকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। এরপর সিনহা যেখানে অবস্থান করছিলেন সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তার ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকে পুলিশ আটক করে। পরে নুরকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
এ ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলে সব মামলারই তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব। পুলিশের করা তিনটি মামলার তদন্তে উত্থাপিত অভিযোগের কোনো সত্যতা না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
ঘটনা তদন্তে ১ আগস্ট চট্টগ্রামের তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই কমিটিতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের প্রতিনিধিও ছিলেন। পরে ৫৮৬ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হয়। ওই ঘটনায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ভূমিকাকে হঠকারি ও অপেশাদারি ছিল বলে উল্লেখ করা হয়।
কক্সবাজারের ওই ঘটনার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ কক্সবাজারে গিয়ে সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে তারা যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উল্লেখ করেন।
সিনহাকে হত্যার ৬ দিন পর ২০২০ সালের ৫ আগস্ট ব্যাপক আলোড়নের মধ্যে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে করে রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া)। সেখানে সিনহা নিহতের ঘটনায় দায়ী সব পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তারের দাবি তোলেন সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা। একই দিন সিনহার বোন শাহরিয়া শারমিন ফেরদৌস বাদী হয়ে লিয়াকত, প্রদীপসহ ৯ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে র্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। ওইদিন বিকেলে মামলায় এজাহারভুক্ত ৯ আসামির মধ্যে ওসি প্রদীপসহ সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
ওই বছরের ১৩ আগস্ট সিনহা নিহতের ঘটনা নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে নানা 'অপপ্রচার' চালিয়ে সেনা-পুলিশ মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে বিবৃতি দেয় পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটি বলে, অপকর্মের জন্য দায়ী ব্যক্তির শাস্তি হবে। ব্যক্তির কোনো অপকর্মের দায় পুলিশ নেবে না।
তদন্ত শেষে র্যাব ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর চার্জশিট দেয়। ২০২১ সালের ২৭ জুন আদালত ১৫ আসামির বিচার শুরুর আদেশ দেন। ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য প্রদান করেন।