আরও ১৮ মামলার বিচার কতদূর

প্রতীকী ছবি
সাহাদাত হোসেন পরশ, ঢাকা আবু তাহের, কক্সবাজার
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ২১:৫৪
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় ঘোষণার পর একই ধরনের ঘটনায় বিচারপ্রত্যাশী কিছু মানুষ আশা দেখতে পাচ্ছেন। যদিও কেউ কেউ এর পরেও আশান্বিত হতে পারছেন না। কারণ দীর্ঘদিন পার হলেও মামলার বিচার শেষ হয়নি। আবার অনেক মামলার তদন্তে আশানুরূপ গতি নেই।
২০২০ সালে সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে গ্রেপ্তারের পর অনেকে সাহস করে মুখ খুলতে শুরু করেন। প্রদীপের বিরুদ্ধে 'বন্দুকযুদ্ধ' ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২১টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ১৭টি কক্সবাজারে, চারটি চট্টগ্রামে। আদালতের নির্দেশে এসব অভিযোগের তদন্তের দায়িত্ব বর্তায় পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের ওপর। এর মধ্যে দুর্নীতির মামলায় প্রদীপের বিরুদ্ধে বিচারকাজ সম্প্রতি শুরু হয়েছে। আর 'বন্দুকযুদ্ধ' ও টাকার জন্য নির্যাতনের তিনটি অভিযোগ থেকে তিনি রেহাই পেয়েছেন। ১৮টি মামলা চলমান।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে সিনহার মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে, এটা ভালো। রায়ের মধ্য দিয়ে এই সত্য বেরিয়ে এলো- 'বন্দুকযুদ্ধে'র যে গল্প, তা সাজানো। অন্য যারা এই ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন তাদের পরিবারেরও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এটা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে।
মিজানুর রহমান আরও বলেন, মাদক দেশে একটি বড় সমস্যা, এটা ঠিক। তবে কেন হত্যার মধ্য দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। তারা নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ করে এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে পারে। শুধু চুনোপুঁটিদের ধরা নয়, পেছনে থেকে যারা কোটি কোটি টাকার কারবার করছে, তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।
কক্সবাজারের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ফরিদুল আলম বলেন, প্রদীপের বিরুদ্ধে সিনহা হত্যাকাণ্ড ছাড়াও ১৮টি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে অনেকগুলোর তদন্ত শেষে আদালতে বিচারাধীন। কিছু অভিযোগের তদন্ত চলছে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, আদালতের নির্দেশে বন্দুকযুদ্ধের চারটি অভিযোগের তদন্ত তারা করছেন। এই চারটিতে প্রধান অভিযুক্ত ওসি প্রদীপ। গুরুত্ব সহকারে তারা তদন্ত করে যাচ্ছেন।
সিনহা হত্যার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেছেন, তার সময়কালে যেসব বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে, তার অধিকাংশ জায়গায় তিনি নিজের অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। কমিটির সদস্যরা তার কাছে জানতে চান- টেকনাফে ৩৩ মাস দায়িত্ব পালনকালে ১০৬টি 'বন্দুকযুদ্ধে'র ঘটনায় ১৭৪ ব্যক্তি নিহত হয়েছে, এগুলো কে সরাসরি নেতৃত্ব দেন? প্রদীপ বলেছেন, বেশির ভাগই তার নেতৃত্বে হয়েছে।
কক্সবাজার ও টেকনাফের একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিনহা হত্যার পর ছয় মাস ওই এলাকায় কোনো 'বন্দুকযুদ্ধে'র ঘটনা ঘটেনি। এরপর আবার কয়েকটি 'বন্দুকযুদ্ধ' হয়। তবে গত তিন মাস ধরে তা আবার বন্ধ রয়েছে।
৭০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে দুই ব্যক্তিকে 'বন্দুকযুদ্ধে' হত্যার অভিযোগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়। এর একটিতে প্রদীপসহ ১৬ জনকে এবং অন্যটিতে ১৫ জনকে আসামি করা হয়। একটি মামলার বাদী হয়েছেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়ার বাসিন্দা লায়লা বেগম। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ বীজ ও সার আনতে উপজেলা সদরের কৃষি অফিসে যান তার স্বামী নুর মোহাম্মদ। এ সময় তাকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে পরিবারের কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন ওসি প্রদীপসহ অন্যরা। তারা পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করে দেন। কিন্তু ২১ মার্চ রাতে নুর মোহাম্মদকে সৈকতের ঝাউবাগানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
নুর মোহাম্মদের স্ত্রী লায়লা বেগম বলেন, 'আমরা এই মামলা নিয়ে আর আগ্রহী নই। ওসি প্রদীপের ফাঁসির রায় হয়েছে, এতেই আমরা খুশি। ফাঁসি দ্রুত কার্যকর হোক- এটাই কামনা করছি।'
অন্য মামলার বাদী একই ইউনিয়নের ডেইলপাড়ার বাসিন্দা হালিমা বেগম। তিনি এজাহারে বলেন, ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর টেকনাফ থানার একদল পুলিশ তার ছেলে মো. আজিজ এবং স্থানীয় নুর হাসান ও আবুল খায়েরকে তুলে নিয়ে যায়। পরে আজিজের পরিবারের কাছে ২০ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি প্রদীপসহ অন্যরা। না দিলে বন্দুকযুদ্ধে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। বিভিন্নভাবে ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে পুলিশকে দেয় আজিজের পরিবার। কিন্তু ১৯ অক্টোবর রাতে টেকনাফের মহেশখালীয়াপাড়া নদীঘাট এলাকায় আজিজকে হত্যা করা হয়।
আজিজের বাবা সালেহ আহমদ বলেন, পুত্র হত্যার বিচার চেয়ে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলাম। মামলার এখন কী অবস্থা জানি না। বেশ কয়েকবার আদালতে গিয়েছি। অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এখন আর পারছি না। মামলা করার পর অনেকে হুমকিও দিয়েছে।
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা মৌলভীবাজার এলাকার মিয়া হোসেনের পুত্র মাহামুদুল হক। দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি প্রবাস থেকে ফেরত আসার পর টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। টাকা না দেওয়ায় ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে পাঁচ লাখ টাকা দিলেও ৩১ মার্চ মাহামুদুল হককে 'বন্দুকযুদ্ধে'র নামে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে ২০২০ সালের ২৬ আগস্ট মামলা করেন নিহতের ভাই নুরুল হোছাইন। এতে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। আদালত টেকনাফ থানাকে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেন। এই মামলার আর কোনো অগ্রগতি নেই।
নুরুল হোছাইন বলেন, আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। ওসি প্রদীপ পাঁচ লাখ টাকা নিয়েও ভাইকে হত্যা করেছে। নিরাপত্তার কারণে মামলা করার সুযোগও ছিল না। প্রদীপ এই হত্যাকাণ্ডের বিচার পাবে কিনা নিশ্চিত নই। আদালতে মামলা করেছিলাম। ওসি প্রদীপ না থাকলেও তার সহযোগীরা তো বাইরে রয়েছে। বুঝতে পারছি, এই মামলার কিছু হবে না।
পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার পরও টেকনাফের মহেশখালীয়াপাড়ার বাসিন্দা অটোরিকশা চালক আবদুল জলিলকে 'বন্দুকযুদ্ধে' হত্যা করা হয়- এমন অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগে প্রদীপের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট আদালতে মামলা করেন নিহতের স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, 'মামলার কী অবস্থা জানি না। এখনও আতঙ্কে রয়েছি। এক প্রদীপ গেলে কী হবে, তার সহযোগী আরও অনেক প্রদীপ বাইরে রয়েছে।'
মামলাগুলোর বিষয়ে টেকনাফ থানার ওসি হাফিজুর রহমান বলেন, আদালত থেকে যেসব প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে, তা যথানিয়মে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
মেজর (অব.) সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস সমকালকে বলেন, আমরা অবশ্যই চাই অন্য যারা বিচারপ্রত্যাশী, তারাও যেন ন্যায়বিচারটা যথাসময়ে পান। ওসি প্রদীপ ও তার লোকজন এই জনপদের মানুষকে দীর্ঘদিন নানাভাবে নির্যাতন করেছে। সিনহা ছিল তাদের শেষ শিকার।
- বিষয় :
- বন্দুকযুদ্ধ
- সিনহা হত্যা
- বিচার