ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

ফেনীর খুশীপুরে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধার আক্ষেপ

ফেনীর খুশীপুরে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধার আক্ষেপ

আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৭:৩৮

ফেনী শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে উপজেলা দাগনভূঞার নিভৃতপল্লি খুশীপুর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই পল্লিতেও নির্মম গণহত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। স্থানীয় গাজারিয়া বাজার থেকে হাঁটা পথে আধাকিলোমিটার এগোলে রাস্তার পাশে নজরে আসবে বিশাল সাইনবোর্ড, যাতে ঠিকানাসহ বড় করে লেখা রয়েছে- '১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আহসান উল্লাহ মিয়ার বাড়ি'। সাইনবোর্ডের পেছনেই দোচালা জীর্ণশীর্ণ একটি টিনের বসতঘর।

বাড়িতে গিয়ে যদি কেউ এই শহীদ পরিবার সম্পর্কে জানতে চান তাহলে দেখা মিলবে ৭০ বছর বয়সী এক নারীর। নাম ছালেহা বেগম। বাড়িতে আর কেউ আছে কিনা, খোঁজ নিলে দেখা যাবে তিনিই ওই ঘরের একমাত্র বাসিন্দা। একই উঠানের দুই ধারে আরও দুটি বসতঘর রয়েছে, যাতে ছালেহা বেগমের দুই দেবর পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করেন।

ছালেহা বেগম জানালেন, তিনি শহীদ আহসান উল্লাহর স্ত্রী। তাঁর এক ছেলে রয়েছেন। ঢাকায় থাকেন। তাঁর একটা দোকান আছে। কেমন আছেন- জানতে চাইলে বিষণ্ণ কণ্ঠে ছালেহা বেগমের উক্তি, 'কেউ খবর রাখে না। স্বামীর (আহসান উল্লাহ) লাশটাও পাইনি। এলাকার সবাই জানে, তাঁরে পাকিস্তানিরা মারছে। নদীতে লাশ ফালাই দিছে। কিন্তু শহীদ বইলা সরকার তাঁরে আজও স্বীকৃতি দিল না। খুব কষ্টে আছি।'

বিষয়টি দাগনভূঞা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা গাজী আবু তাহেরের নজরে নেওয়া হয়। তিনি সমকালকে বলেন, 'সহযোদ্ধা আহসানের দুর্ভাগ্য, তাঁকে আমরা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিতে পারিনি। অথচ উপজেলার সব মুক্তিযোদ্ধাই আহসানের বিষয়টি জানেন। তাঁর ব্যাপারে উপজেলা থেকে সহযোদ্ধাদের সুপারিশ ঢাকায় জামুকা (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) অফিসে পাঠানো হয়েছিল। জামুকার চেয়ারম্যান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী দুইবার আহসানের স্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। কিন্তু আহসানের স্বীকৃতি মেলেনি।'

আহসানের শহীদ হওয়া প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, ত্রিপুরায় তাঁদের সঙ্গে আহসান ২১ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। উপজেলার আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যাঁরা ওই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এক দিন হঠাৎ করে আহসান তাঁদের বলেন, মাছুম ছেলেটার জন্য মনটা কেমন করে। তিনি দেখতে যাবেন। গোপনে যাবেন।

তখন আহসানকে বোঝানো হয়, কমান্ডারকে না জানিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। অনেক বোঝানোর পর ক্যাম্প কমান্ডার লে. কর্নেল জাফর ইমামের (মুক্তিযুদ্ধের পর বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত হন) কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এক দিন রাতে আহসান বাড়িতে যান। সঙ্গে মার্ক থ্রি রাইফেল ছিল। সপ্তাহখানেক পর জানতে পারা যায়, ৩-৪ দিন আগে পাকিস্তানিরা আহসানকে হত্যা করেছে।

শহীদ আহসানের বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সমকালকে বলেন, 'কাগজপত্র না দেখে কিছু বলা যাবে না। উপজেলার সুপারিশের পরও যদি তাঁর পরিবারের আবেদন বাতিল হয়ে থাকে, তাহলে আপিলের সুযোগ আছে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।'

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করার পর সেনা কনভয়গুলো জেলা-উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলে পাঠানো হতে থাকে। স্থানীয়ভাবে পুলিশ ও ইপিআরের অস্ত্র দিয়ে গড়ে তোলা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রতিরোধ ভেঙে পড়তে থাকে। মার্চের শেষদিকেই ফেনী কলেজ মাঠে এবং বর্তমান দাগনভূঞা উপজেলার ২ নম্বর রাজাপুর ইউনিয়নের রাজাপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালিদের এই ক্যাম্পে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হতো।

আহসান ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে গ্রামে ফিরে আসেন। তাঁর স্ত্রী ছালেহা বেগমের সদ্য সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। আহসানের গ্রামে থাকা নিরাপদ ছিল না। রাজাকাররা প্রায় বিভিন্ন বাড়িতে তল্লাশি চালাত। এমন পরিস্থিতিতে স্ত্রী ও পুত্রকে বাড়িতে রেখে আরও অনেকের সঙ্গে আহসান এপ্রিলের শেষদিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিলোনিয়া ক্যাম্পে চলে যান। আহসান ক্যাম্পের কমান্ডারের অনুমতি নিয়ে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে দাগনভূঞার খুশীপুরে নিজ বাড়িতে আসেন সন্তানকে দেখার মায়ায়। ওই রাতেই খবর পেয়ে যায় রাজাকার বাহিনী। মধ্যরাতে তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে। পরে আহসানকে ধরে নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্পে তুলে দেয় রাজাকাররা। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ছালেহা জানতে পারেন, আহসানের চোখ ও হাত-পা বেঁধে গুলি করে স্থানীয় সিলোনিয়া সেতুর কাছে নদীতে ফেলে দিয়েছে পাকিস্তানি হানাদাররা।

ছালেহা বেগম সমকালকে বলেন, 'স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দুই হাজার টাকা আর ইয়াছিনের (ছেলে) বাবার নাম করে একটা চিঠি দিছিল। চিঠিটা এখনও আছে। আর কোনো সাহায্য পাই নাই। জমিজমা যা আছিল, তাই দিয়া চলছে। ছেলেটা চাকরি করত। এখন একটা দোকান দিছে।'

শহীদসন্তান ইয়াছিন মিয়া বলেন, 'তদবির নাই বলে বাবারে স্বীকৃতি দেয় নাই। তাঁর সহযোদ্ধারা প্রায় সবাই মারা গেছেন। বাবা কোথায় ট্রেনিং নিছেন, কীভাবে শহীদ হয়েছেন, সেটা আমার মা কেমন করে প্রমাণ করবেন? আমরা চাই বাবাকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হোক।'

ফেনী জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা ও শহীদ স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে আমরা স্থানীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে নানামুখী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। যেসব স্থাপনা চিহ্নিত হয়েছে, তা সংরক্ষণ করা হবে। তিনি ছালেহা বেগমের বিষয়টি খোঁজ নিয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

আরও পড়ুন

×