সাগর-রুনি হত্যার ১১ বছর
'বিচার চাই, মেঘের কাছে দায়মুক্ত হতে চাই'

মা-বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মাহির সরওয়ার মেঘ। একটু ছুঁয়ে দেখা। এ যেন অকৃত্রিম ভালোবাসার পরশ - সংগৃহীত
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ২৩:০৪
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের ১১ বছর পার হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়েও হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি। এ পর্যন্ত ৯৫ বার পিছিয়েছে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ। হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে গতকাল শনিবার রাজধানীর ইন্দিরা রোডের 'কালিন্দী' বাড়ির একটি ভবনের দোতলায় 'সাগর-রুনি ক্রাইম সিন ডু নট ক্রস' শিরোনামে দিনব্যাপী প্রতিবাদী চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সাগর ও রুনির পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা অভিনব এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। ১০ জন শিল্পীর চিত্রকর্ম, সাগর-রুনির ব্যবহার করা জিনিসপত্র, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও তাঁদের ছবি নিয়ে এই প্রদর্শনীর আয়োজন। সকাল ১১টায় শুরু হয়ে প্রদর্শনী চলে রাত ৮টা পর্যন্ত।
প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা আলোকচিত্রী শহিদুল আলমসহ অনেকে। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মন্তব্য খাতায় লিখেছেন, 'বিচার চাই, মেঘের কাছে দায়মুক্ত হতে চাই।'
'ঘণ্টা-মাস-বছর পেরিয়ে কত কী যে হলো, এর পরও প্রাপ্তির খাতায় শুধুই নিদারুণ শূন্যতা। আদালতের ধুলোপড়া বারান্দায় পড়ে রইলো তদন্তের ব্যর্থতা।' প্রদর্শনীতে আক্ষেপ করে কথাগুলো বলেন সাংবাদিক মেহেরুন রুনির ভাই ও মামলার বাদী নওশের রোমান। তিনি বলেন, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে নিজ বাসায় খুন হন সাগর ও রুনি। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হবে বললেও হত্যাকারীরা শনাক্ত হয়নি এখনও। এর পর হত্যাকারীদের চিহ্নিত করতে ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার কথা বলা হলেও এর কোনো কূলকিনারা নেই। তদন্তে বিন্দুমাত্র অগ্রগতি নেই। সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া এ হত্যার বিচার সম্ভব নয়। ১১ বছরেও বিচার পাইনি। আমরা বিচার চাইতেও এখন লজ্জা পাই। বিচার চাইব কার কাছে।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলার কক্ষে ঢুকতেই দেখা গেল দেয়ালে ঝুলছে সাগর-রুনির একমাত্র ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘের একটি পাঞ্জাবি। দেয়ালজুড়েই তিনজনের একসঙ্গে বিভিন্ন ছবি, ব্যবহারের কাপড় ও নানান জিনিস। মা-বাবাকে নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল মেঘ। সে বলছিল, 'মা-বাবাকে সব সময় মনে পড়ে। সপ্তাহে একবার তাঁদের কবরে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমি বাবা-মা হত্যার বিচার চাই।'
হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশপ্রধানের বক্তব্য টিভি স্ট্ক্রিনে প্রচার করা হয়। কক্ষটির এক কোণে রাখা পারিবারিক অনেক ছবি। আরও রয়েছে সাগরের লেখা কয়েকটি বই। সেখানে একটি ফ্রেমে বাঁধাই করা মাকে নিয়ে মাহিরের আঁকা একটি ছবি। সেখানে মাহির লিখেছে- 'আই লাভ ইউ মা।'
বিচারের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলনের ঘোষণা ডিআরইউর: সাগর-রুনি হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সাংবাদিকদের সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)। শনিবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ডিআরইউ চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশে এ ঘোষণা দেন সংগঠনটির নেতারা।
ডিআরইউ সভাপতি মুরসালিন নোমানীর সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেলের সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী, ডিআরইউর সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ, ডিআরইউ সহসভাপতি দীপু সারোয়ার, যুগ্ম সম্পাদক মঈনুল আহসান, সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, দপ্তর সম্পাদক কাওসার আজম, নারীবিষয়ক সম্পাদক মরিয়ম মনি সেঁজুতি, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মনির মিল্লাত, ইসমাঈল হোসাইন রাসেল, কিরণ শেখ, আলী ইব্রাহিম, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী বোরহান উদ্দিন, ডিআরইউর স্থায়ী সদস্য কাজী জাহিদুল হাসান, মাজহারুল হক মান্না, তৌহিদুর রহমান, মো. আসাদুজ্জামান, মো. আবু দাউদ খান প্রমুখ। তাঁরা বলেন, সাগর-রুনি হত্যার পর থেকে সাংবাদিকরা দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের দাবিতে সোচ্চার রয়েছেন। এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত ডিআরইউ ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি জানিয়েছে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি)। শনিবার বিজেসি চেয়ারম্যান রেজোয়ানুল হক ও সদস্য সচিব শাকিল আহমেদ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।
এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর কাছে আবেদন জানিয়েছিল ডিআরইউ। ১১ বছর ধরে সাগর-রুনি হত্যার বিচার চেয়ে আন্দোলন করছেন সহকর্মীরা। তবে কিছুতেই কিছু হয়নি। গত বৃহস্পতিবার সাগর-রুনি হত্যা মামলার প্রতিবেদন দিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে স্মারকলিপি দেন ডিআরইউ নেতারা। এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়ে আশ্বাস দেন।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনিকে হত্যা করা হয়। এর পর রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। নানা হাতে ঘুরে তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব।