বিতর্কিত সরকারি কর্তার লুকিয়ে ঠিকাদারি

জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৩ | ১৮:০০
রেজাউল ইসলাম মুকুল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিকল্পনা, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও আইসিটি উইংয়ের সহকারী প্রধান (পলিসি প্ল্যানিং)। মাস তিনেক আগে তিনি ছিলেন ‘কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর’ শীর্ষক প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক। ওই সময় প্রভাব খাটিয়ে পরোক্ষভাবে ঠিকাদার বনে যান তিনি। ঠিকাদারের লাইসেন্স ভাড়া করে কাজ করতে থাকেন। বিষয়টি জানাজানির পর কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
প্রকল্প থেকে সরে গেলেও কমেনি রেজাউলের দাপট। এখনও তিনি ওই প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নিতে নানা তদবির করছেন। এতে ব্যবহার করছেন ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদেরও। আর এতে ল্যাবরেটরি নির্মাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, রেজাউল ইসলাম মুকুল ২০০১ সালে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। ২০০৭ সালে তিনি বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও বরগুনা স্মলহোল্ডার সাপোর্ট প্রকল্পের সহকারী পরিচালক ছিলেন। ২০১০ সালে ছিলেন বৃহত্তর বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের লবণাক্ত পতিত জমিতে সম্প্রসারণ কর্মসূচির পরিচালক। এর মধ্যে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। বেশ কয়েক বছর পর আবার চাকরিতে যোগ দিয়ে উপপ্রকল্প পরিচালক পদ পান। এখানেও ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাসহ নানা অভিযোগে প্রকল্পের মাঝপথে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর এ নিয়ে বাধে বিপত্তি। দায়িত্ব ছাড়তে গড়িমসি শুরু করেন তিনি। স্বপদে বহাল থাকতে করেন তদবির। তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের চাপে তাঁর সেই চেষ্টা টেকেনি। নতুন কর্মস্থলে যোগ দিলে নিয়মিত অফিস করছেন না। কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউস প্রকল্পের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, রেজাউলকে সরিয়ে দেওয়া হলেও এ প্রকল্পে তাঁর ছায়া এখনও আছে। এখানে অনেকেই তাঁর ঘনিষ্ঠ। ফলে তিনি ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে এখনও মরিয়া।
২০২১ সালের জুন থেকে ১৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। ২০২৪ সালের জুনে এটি চালু হবে। এরই মধ্যে এই ল্যাবটির অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রায় সিংহভাগই শেষ হয়েছে। ১০টি ল্যাব স্থাপনের জন্য গত ৬ মার্চ দরপত্র আহ্বান করা হয়।
জানা যায়, এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয়ে উন্নতমানের কনফারেন্স ও ট্রেনিং রুম সংস্কার কাজ চলমান। দরপত্রের মাধ্যমে সংস্কারের কাজ পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাল্টিবিজ ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ইকবাল হোসেন বলেন, ‘কাজ পাওয়ার পর রেজাউল ইসলাম মুকুলকে ২৫ লাখ টাকা কমিশন দিতে হয়েছে। কাজটি তাঁকে দিয়ে করাতে আমাকে চাপ দিতে থাকেন। এ জন্য ৮০ লাখ টাকা নেন, যার বিলের কপি আমার কাছে আছে। শর্ত ছিল পুরো কাজ শেষ করে তিনি আমাকে বুঝিয়ে দেবেন। সব খরচ বাদে ১০-১৫ লাখ টাকা আমার লাভ থাকার কথা। কিন্তু রেজাউল মাত্র ৪০ শতাংশ কাজ করেছেন। এখন বাকি কাজ আমাকেই শেষ করতে হচ্ছে। এতে আমার বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে।’
মাল্টিবিজ ইন্টারন্যাশনালের লাইসেন্স ব্যবহার করে শিহাব সজল নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে ৪০ শতাংশ কাজ রেজাউল ইসলাম মুকুল করেছেন বলে জানা গেছে। মাল্টিবিজ ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃপক্ষ বলছে, শিহাব সজল নামে কারও সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ নেই। এ কাজের বিল মাল্টিবিজ পরিশোধ করেছে রেজাউল করিম মুকুলকে। তিনি (রেজাউল) শিহাবের প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। এ ছাড়া কেমিক্যাল সরবরাহসহ আরও বেশ কয়েকটি কাজ অন্যের লাইসেন্স ব্যবহার করে রেজাউল করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০তম কৃষি ক্যাডারের কর্মকর্তা রেজাউল ইসলাম মুকুল প্রায় এক যুগ আগে চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। তাঁর ব্যাচের কৃষি কর্মকর্তারা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হয়েছেন ছয় বছর আগে। তবে রেজাউল গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি নবম গ্রেড থেকে সরাসরি পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন ষষ্ঠ গ্রেডের কর্মকর্তা।
অভিযোগের বিষয়ে রেজাউল ইসলাম মুকুল বলেন, ‘একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে অপ্রচার চালাচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তা হয়ে ঠিকাদারি করার সুযোগ নেই। আমি শুধু তদারকি করেছি।’ চাকরি থেকে বরখাস্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘চাকরি-সংক্রান্ত কোনো কারণে আমি বরখাস্ত হইনি। আমাদের পারিবারিক গার্মেন্ট ব্যবসা আছে। তখন আমার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছিল। মামলা মীমাংসা হলে ৩-৪ বছর পর আবার চাকরিতে যোগ দিয়েছি।’
এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘রেজাউল অনেক দিন বরখাস্ত ছিলেন, এটি জানি। নতুন অভিযোগগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি।’
- বিষয় :
- ঠিকাদারি
- কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর