ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

মাদক মামলায় সাক্ষ্য দেন না খোদ তদন্ত কর্মকর্তারাও

মাদক মামলায় সাক্ষ্য দেন না খোদ তদন্ত কর্মকর্তারাও

বকুল আহমেদ

প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ১০ হাজার ২০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে মো. হাসান নামে এক মাদক কারবারিকে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দুই নম্বর আদর্শবাগের একটি বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে যাত্রাবাড়ী থানায় এ নিয়ে মামলা হয়। ডিএনসির পরিদর্শক ফজলুল হক খান তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেন। তাতে একমাত্র অভিযুক্ত মো. হাসান। গত ২০ মার্চ মামলাটির রায় ঘোষণা করেন ঢাকার ৭ নম্বর বিশেষ জজ আদালত। রায়ে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপক্ষ আসামি মো. হাসানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। তাই তাকে খালাস দেওয়া হলো।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফজলুল হক খান নিজেই সাক্ষ্য দেননি এই মামলায়। ছয় সাক্ষীর মধ্যে মাত্র দু’জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। একাধিকবার সমন জারির পরও বাকি সাক্ষীরা আদালতে হাজির হননি।

শুধু এই মামলাটিই নয়, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১৪ বছর ৪ মাসে সারাদেশে ডিএনসির করা ১৭ হাজার ২৬টি মাদক মামলা খারিজ হয়েছে, যা মোট মামলার ৫০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এতে খালাস পেয়েছেন ১৮ হাজার ৯৪৭ জন, যা মোট আসামির ৫২ দশমিক ১৭ শতাংশ।

১০ হাজার ২০০ পিস ইয়াবার ওই মামলার চার্জশিটে সাক্ষী ছিলেন মামলার বাদী ডিএনসির পরিদর্শক এ কে এম কামরুল ইসলাম, তদন্তকারী কর্মকর্তা ফজলুল হক খান, উপপরিদর্শক মজিবর রহমান, সিপাহি রফিকুল ইসলাম এবং দু’জন পাবলিক। তাদের মধ্যে শুধু কামরুল ইসলাম ও মজিবর রহমান সাক্ষ্য দিয়েছেন।

কেন আদালতে সাক্ষ্য দিতে গেলেন না– এই প্রশ্নে ফজলুল হক খান সমকালকে বলেন, ‘সাক্ষ্য দিয়েছি কি দেইনি, তা মনে নেই। কত মামলার সাক্ষী হই, কয়টা মনে থাকে?’ মামলাটি খারিজ হওয়ার বিষয়টি শুনেছেন বলে জানান তিনি।

খালাস পাওয়া হাসানের বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফের গোদারবিল গ্রামে। তাঁর বাবা মৃত আলী জোহার। যাত্রাবাড়ীর আদর্শবাগে ভাড়া থাকতেন তিনি।

নিষ্পত্তি হওয়া বেশ কয়েকটি মাদক মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, সেগুলো খারিজ হওয়ার অন্যতম কারণ সাক্ষী আদালতে হাজির না হওয়া। পাবলিক সাক্ষীর পাশাপাশি মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ সরকারি সাক্ষীরাও সাক্ষ্য দেননি। এ ছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। এসব কারণে আসামিরা আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন।

আইনজীবী এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাক্ষ্য হচ্ছে মামলা প্রমাণের মূল ভিত্তি। আসামির সাজা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আদালতে সাক্ষ্য প্রদান গুরুত্বপূর্ণ। তদন্ত কর্মকর্তার ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরও বেশি। এ ছাড়া ত্রুটিমুক্ত এজাহার, নির্ভুল চার্জশিট এবং জব্দ তালিকায় নিরপেক্ষ সাক্ষীসহ অন্যান্য বিষয় তো আছেই।

ডিএনসির মহাপরিচালক মো. আবদুল ওয়াহাব ভুঞা সমকালকে বলেন, সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য কোন মাসে কতজন সমন পেয়েছেন, মাসে কতজন সাক্ষী আদালতে হাজির হয়েছেন, সেসব বিষয়ে খোঁজ রাখা হচ্ছে। যদি দেখি কোনো কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হচ্ছেন না, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সরকারি তিন কর্মকর্তা-কর্মচারী সাক্ষ্য দেননি

২০২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মহানগর উত্তর বিভাগের গুলশান সার্কেল বারিধারার দূতাবাস রোডের একটি বাসায় অভিযান চালায়। সেখান থেকে তারেক আহম্মেদ নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধার হয় পাঁচ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস) ও ১০০ পিস ইয়াবা। এ ঘটনায় গুলশান থানায় ডিএনসি একটি মামলা করে। মামলাটির বাদী ছিলেন উপপরিদর্শক শেখ মো. সাজ্জাদ হোসেন। তদন্ত শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মির্জা মো. মনিরুজ্জামান আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ সাক্ষী ছিলেন সাতজন। এর মধ্যে আদালতে সাক্ষী দেন মাত্র দু’জন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান, সহকারী উপপরিদর্শক মো. আজাদ হোসেন ও সিপাহি মুহাম্মদ আছাদুর রহমান এবং অন্য দুই পাবলিক আদালতে সাক্ষ্য দেননি। 

গত ৬ মার্চ মামলাটির রায় ঘোষণা করেন ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেটের ১১ নম্বর আদালত। এতে আসামি তারেক খালাস পান। রায়ে বলা হয়, আসামি তারেক আহম্মেদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ না হওয়ায় তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মির্জা মো. মনিরুজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘সাক্ষ্য দেইনি। কখন সমন এসেছিল স্মরণ নেই। কারণ প্রায়ই মামলার সাক্ষী থাকে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারেক আহম্মেদ জামিন পেয়ে লন্ডনে চলে যান। পরে দেশে ফিরে তিনি আবার আইস কারবারে জড়িয়েছেন। নিজেও আইস সেবন করেন।

রাসায়নিক রিপোর্ট আদালতে প্রদর্শিত করা হয়নি

২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে আড়াইশ’ গ্রাম গাঁজাসহ চাঁদনী আক্তার (২২) নামে এক নারীকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মহানগর উত্তর বিভাগের একটি দল। এ ঘটনায় উপপরিদর্শক আসহাব উদ্দিন আহাম্মদ বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় মামলা করেন। এটির তদন্ত শেষে পরিদর্শক মো. ইকবালুর রহমান আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।

গত ১২ জানুয়ারি মামলাটির রায় ঘোষণা করেন ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেটের ২৫ নম্বর আদালত। এতে আসামি চাঁদনী খালাস পেয়েছেন। ছয়জন সাক্ষীর মধ্যে শুধু মামলার বাদী সাক্ষ্য দিয়েছেন। বাকিরা কেউ সাক্ষ্য দেননি। তারা হলেন– ডিএনসির সিপাহি আমেনা বেগম ও শরীফ মাহমুদ আলী খান এবং দু’জন পাবলিক সাক্ষী। আসামির শাস্তি নিশ্চিতের জন্য সরকারি সাক্ষীরাই সাক্ষ্য দেননি। শুধু তাই নয়, মামলায় জব্দকৃত আলামতের রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্ট আদালতে প্রদর্শিত করা হয়নি। অবশ্য মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সাক্ষী ডিএনসির পরিদর্শক ইকবালুর রহমান এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন।

রায়ে বলা হয়েছে– আসামি চাঁদনীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। এ কারণে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে তাকে।

সাজার সংখ্যা কম

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে সারাদেশে ডিএনসির ৩৩ হাজার ৬০৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে আদালতে। এতে আসামি ছিলেন ৩৬ হাজার ৩১৭ জন। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়– খালাসের চেয়ে সাজার সংখ্যা কম। মোট মামলার মধ্যে ১৭ হাজার ২৬টি খারিজ হয়েছে। সাজা হয়েছে ১৬ হাজার ৫৮০ মামলায়। মোট আসামির মধ্যে খালাস পেয়েছেন ১৮ হাজার ৯৪৭ জন। আর সাজা পেয়েছেন ১৭ হাজার ৩৭০ জন। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে সাজা হয়েছে ৪৯ শতাংশ অভিযুক্তের। এ ছাড়া ২০২২ সালে ৩৯ শতাংশ, ২০২১ সালে ৫০ শতাংশ, ২০২০ সালে ৪৩ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৩৮ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৪১ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৪০ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৪১ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৪৮ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৫১ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৫৪ শতাংশ, ২০১২ সালে ৫৩ শতাংশ, ২০১১ সালে ৬১ শতাংশ, ২০১০ সালে ৬০ শতাংশ এবং ২০০৯ সালে ৫৬ শতাংশ আসামির সাজা হয়।

অবশ্য খালাসের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে নানা কারণ রয়েছে। কয়েক বছর আগে খোদ ডিএনসির একটি অনুসন্ধানে উঠে আসে, আট কারণে মাদক মামলায় অভিযুক্তরা খালাস পান। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে– ত্রুটিপূর্ণ এজাহার দাখিল, মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা একই ব্যক্তি হওয়া, জব্দ তালিকায় বর্ণিত স্থানীয় সাক্ষীর সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যে অমিল, জব্দ তালিকায় উল্লিখিত সাক্ষী ও অন্যান্য সাক্ষী আদালতে হাজির করতে ব্যর্থতা, উপযুক্ত, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী উপস্থাপনে ব্যর্থতা, মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য না দেওয়া, আইনের বিধান অনুযায়ী জব্দ তালিকা তৈরি না করা এবং মামলার বাদী ও অভিযানকারী দলের সদস্যদের বক্তব্যে অমিল।

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক সমকালকে বলেন, মাদক মামলায় সাজা হওয়া কঠিন ব্যাপার। এ জন্য জব্দ তালিকার নিরপেক্ষ সাক্ষীকে অবশ্যই সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালতে হাজির করতে হবে। তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাকে সাক্ষ্য দিতেই হবে। কীভাবে তদন্ত করলেন, কীভাবে প্রমাণ করলেন– পুরো বিষয়টি তো তদন্ত কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির হয়ে বলতে হবে। এ ছাড়া এজাহার, চার্জশিট এবং জব্দ তালিকা সঠিক হওয়া দরকার।

ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ‘সাক্ষী দিয়ে যদি মামলা প্রমাণ না করা যায়, তাহলে তো আসামির খালাস হবেই। অনেক সময় সাক্ষীরা আদালতে এসে বলেন, তারা মাদক জব্দ করতে দেখেননি, ঘটনাস্থলেও ছিলেন না। সাক্ষী হিসেবে শুধু তাদের সই নেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেন, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।’ মামলার বাদী, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও আভিযানিক দলের সাক্ষীরা আদালতে হাজির না হলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন এই আইনজীবী।

আরও পড়ুন

×