ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

বিশ্লেষণ

স্বীকৃতিহীন সীমান্ত নদীর তিন কূল ভাঙে

স্বীকৃতিহীন সীমান্ত নদীর তিন কূল ভাঙে

গবেষক ও সাংবাদিক শেখ রোকন। ছবি: সংগৃহীত

শেখ রোকন

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ০৩:৪৮

প্রাকৃতিকভাবেই নদী এক কূল ভাঙে, আরেক কূল গড়ে। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট কারণে নদী যখন চাপে পড়ে, প্রাণ বাঁচাতে হাঁসফাঁস করতে থাকে; তখন একযোগে দুই কূলেই ভাঙতে পারে। আন্তঃসীমান্ত নদীর ক্ষেত্রেই দু’কূল ভাঙার ঘটনা বেশি দেখা যায়। কারণ, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে প্রবাহিত ও দাপ্তরিকভাবে স্বীকৃত নদীগুলোর বেশির ভাগই পানি প্রত্যাহার ও প্রবাহ রোধ বা ঘুরিয়ে দেওয়ার শিকার। আর যেসব আন্তঃসীমান্ত বা আন্তর্জাতিক বা সীমান্ত বা অভিন্ন নদী দুই দেশের দাপ্তরিক স্বীকৃতি পায়নি, সেগুলোর যেন তিন কূল ভাঙা। কারণ, এগুলোর পানি প্রত্যাহার হলে বা প্রবাহ ঘুরিয়ে দেওয়া হলেও ভাটির দেশ থেকে প্রতিবাদ বা আলোচনার পথটুকুও থাকে না। হতাশার বিষয়, বাংলাদেশ স্বীকৃত আন্তঃসীমান্ত নদীর তুলনায় অস্বীকৃত আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যাই বেশি।

সবাই জানেন, বাংলাদেশে দাপ্তরিকভাবে স্বীকৃত আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা ৫৭টি। এর মধ্যে তিনটি মিয়ানমারের সঙ্গে, বাকি ৫৪টি ভারতের সঙ্গে। কিন্তু আমরা গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, এ ধরনের নদীর প্রকৃত সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। যেমন ভারতের সঙ্গে, তেমনি মিয়ানমারের সঙ্গে।

স্বাধীনতার প্রায় অব্যবহিত পরেই আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে ভারতের সঙ্গে বোঝাপড়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে দূরদর্শিতার পরিচায়ক ছিল। এ কথা অনেকবারই লিখেছি, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান, যোগাযোগ, কর্মসংস্থান যখন সবচেয়ে জরুরি ছিল; তখনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তঃসীমান্ত নদীতে অধিকার ও ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি ভোলেননি। কিন্তু সে সময় যারা তালিকাটি প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা সম্ভবত যথেষ্ট মনোযোগের সঙ্গে কাজটি করেননি। অন্যথায় অর্ধেকের বেশি নদী বাদ পড়ার কথা নয়।

আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেলেও তালিকা থেকে বাদ পড়া আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ব্যাপারে দাপ্তরিকভাবে সামান্যই উদ্যোগ দেখা গেছে। শেষ পর্যন্ত কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের পক্ষে আরও ১৬টি নদীর তালিকা ভারতের কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে বটে, অগ্রগতি অজানা। এমনকি যৌথ নদী কমিশন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে জনপরিসরে আলোচনা করতেও যেন কুণ্ঠিত। অথচ আন্তর্জাতিক আইন, সনদ, নীতি ও রেওয়াজ অনুযায়ী প্রতিটি আন্তঃসীমান্ত নদীর প্রতি ফোঁটা পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার রয়েছে।

শুধু অধিকার ও হিস্যার প্রশ্ন নয়; বাংলাদেশে প্রবাহিত অন্যান্য নদীর প্রবাহ, প্রতিবেশ, নৌ যোগাযোগ, মৎস্যসম্পদ, সেচ এমনকি সেগুলোর চিত্তবিনোদনমূলক উপযোগিতা অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থেও আন্তঃসীমান্ত নদীর সঠিক তথ্য ও যথাযথ উপাত্ত থাকা জরুরি। কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও রংপুর অঞ্চলের হাতেগোনা কয়েকটি নদীর কথা বাদ দিলে দেশের বাকি সব নদীই কোনো না কোনোভাবে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ওপর নির্ভরশীল। আন্তঃসীমান্ত নদীর উজানে যদি কোনো স্থাপনার মাধ্যমে প্রবাহ হ্রাস, ঘুরিয়ে দেওয়া বা প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে এর বিরূপ প্রভাব অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতেও পড়তে বাধ্য। এখন অর্ধেকের বেশি যদি স্বীকৃতিহীন হয়, তাহলে দেশের গোটা নদী ব্যবস্থার জন্য এই চিত্র গুরুতর ঝুঁকির বিষয়। যদি সঠিক তালিকা ও তথ্য-উপাত্ত না থাকে, তাহলে আন্তঃসীমান্ত নদীতে ভাটির দেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা কমে এবং অধিকার হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়। আমাদের নীতিনির্ধারকরা অনেক সময়, সংগতভাবেই অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনার কথা বলেন। কিন্তু অববাহিকার সব নদীর যদি স্বীকৃতিই না থাকে, তাহলে দুই দেশের মধ্যে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা হবে কীভাবে?

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ছোট-বড় প্রতিটি নদীর নিজস্ব প্রতিবেশ ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া আন্তঃসীমান্ত নদীর সঙ্গে বন্যা, পাহাড়ি ঢল, নদীভাঙন, ভূমির গঠন পরিবর্তন, বিসবুজীকরণের মতো দুর্যোগ জড়িত। এসব বিষয়ে যদি অভ্যন্তরীণভাবে পরিকল্পনা, প্রকল্প, নীতি প্রণয়ন করতে চাই, তাহলে আন্তঃসীমান্ত নদীর পূর্ণ বিবরণী থাকা জরুরি। মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পেতে এবং এ-সংক্রান্ত পরিকল্পনা, নীতি ও প্রকল্প প্রণয়নে আন্তঃসীমান্ত সব নদী সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।

ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, বরাক বা তিস্তার মতো বৃহৎ আন্তঃসীমান্ত নদীর সঙ্গে অপেক্ষাকৃত ছোট অনেক আন্তঃসীমান্ত নদী শাখানদী বা উপনদী হিসেবে সংযুক্ত। শাখানদী ও উপনদীগুলোর পরিস্থিতি জানা না থাকলে বড় নদীগুলোর বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা কীভাবে সম্ভব?

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নৌ যোগাযোগ, পর্যটন, পরিবহন ও বাণিজ্য বাড়ানোর উদ্যোগ আগের তুলনায় বেড়েছে। অথচ অপেক্ষাকৃত ছোট আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো স্থানীয় পর্যায়ের এসব কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা কেবল বড় বড় বিষয়েই কথা বলব, ছোটগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করব না?

নতুন ১৬টি আন্তঃসীমান্ত নদী প্রস্তাব করার পর ভারতের দিক থেকে নতুন একটি প্রশ্ন উঠেছে বলে আমরা অনানুষ্ঠানিকভাবে জেনেছি। তারা বলছে, আন্তঃসীমান্ত নদীর সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে হবে আগে। আমার মতে, ছোট বা বড় যা-ই হোক, সীমান্ত অতিক্রমকারী বা সীমান্তরেখা ধরে প্রবাহিত যে কোনো প্রাকৃতিক প্রবাহকেই আন্তঃসীমান্ত নদী হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। গোটা বিশ্বে সেটাই নিয়ম। আর অর্ধশতাব্দী আগেই আন্তঃসীমান্ত নদী যেভাবে চিহ্নিত হয়েছে এবং আলোচনা চলে আসছে, এখনও সেটাই সংগত। এখন কেবল সংখ্যা বৃদ্ধি বা অস্বীকৃতগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়। সদিচ্ছা থাকলে এটি জটিল কোনো বিষয় হতে পারে না।

সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে আন্তঃসীমান্ত নদীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নে উদ্যোগী হওয়া। এ ব্যাপারে যত দেরি হবে, ততই পরিস্থিতি জটিল হতে থাকবে। এ ক্ষেত্রে নদী নিয়ে গবেষণারত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরকারের সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব জরুরি।

একটা সময় ছিল, যখন আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে গবেষণা সহজ ছিল না। মনে আছে, ২০০০ সালের দিকে যখন প্রথম আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে গবেষণা শুরু করি, তখন গুগুল সার্চ ইঞ্জিন ছিল না, স্যাটেলাইট ইমেজ দেখার সুযোগ ঘরে ঘরে ছিল না, অনলাইন সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যম ছিল না। যে কারণে দাপ্তরিক তালিকাভুক্ত লংলা নদী খুঁজতেই অনেক দিন লেগেছিল। এখন তো সেই সীমাবদ্ধতা নেই। দেশের অভ্যন্তরে তো বটেই, সীমান্তের ওপারেও কাঙ্ক্ষিত নদীর উৎস ও প্রবাহপথ ঘরে বসেই যাচাই করা সম্ভব।

একই সঙ্গে সব আন্তঃসীমান্ত নদীর আন্তঃদেশীয় স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে প্রস্তাব, আলোচনা ও কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে। সব ধরনের আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিপ্রবাহ ও নদীকাঠামো সংরক্ষণ ও উন্নয়নে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের গীতিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নদীর কাছে প্রশ্ন রেখে গেয়েছিলেন, ‘এ কূল ভেঙে ও কূল তুমি গড়ো/ যার এ কূল ও কূল দুকূল গেল তার লাগি কি করো?’ স্বীকৃতিহীন আন্তঃসীমান্ত নদীর তো তিন কূল যাচ্ছে। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব?

নদী গবেষক : সহযোগী সম্পাদক, সমকাল

আরও পড়ুন

×