ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

ফরিদপুর-৩

মনোনয়নের আগেই নিজেকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেন হল্যান্ড শামীম

মনোনয়নের আগেই নিজেকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেন হল্যান্ড শামীম

ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত শামীম হক ওরফে হল্যান্ড শামীম

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০০:৫২ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১২:১৪

সংসদ নির্বাচনের নৌকার প্রার্থী তালিকা আওয়ামী লীগ ঘোষণা করে গত ২৬ নভেম্বর। তবে এর পক্ষকাল আগেই নিজেকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেন ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত শামীম হক ওরফে হল্যান্ড শামীম। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিজের ডাচ নাগরিকত্ব ত্যাগের যে নথি তিনি জমা দিয়েছেন, সেখানেই রয়েছে এ তথ্য।

ইসিতে শামীমের জমা দেওয়া নথি থেকে জানা গেছে, গত ১০ নভেম্বর তিনি নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ডাচ নাগরিকত্ব প্রত্যাহারের বিষয়টি অবগত করে একটি চিঠি দেন। সেই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি শামীম হক, জন্মসূত্রে বাংলাদেশের একজন নাগরিক এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর সদর আসনের আওয়ামী লীগের মনোনীত একজন প্রার্থী।’

তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি কার্যক্রমই শুরু হয় ১৮ নভেম্বর। পরে ২১ থেকে ২৫ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করে। ২৬ নভেম্বর সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৮টিতে নৌকার প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে দলটি।

প্রশ্ন উঠছে, দলের মনোনয়ন বোর্ডের যাচাই-বাছাই ও ঘোষণার আগেই কীভাবে নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিজেকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন শামীম! এ বিষয়ে জানতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমার... আর কোনো কিছুই করতে পারবা না। এখন তোমাদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করব। কালকে নির্বাচন কমিশনে যাও, সব দেখতে পারবা। আইন কথা বলবে, পেপার কথা বলবে।’

শামীম দ্বৈত নাগরিক হওয়ায় বুধবার ইসিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভাপতিত্বে তাঁর প্রার্থিতার বৈধতা নিয়ে শুনানি হয়। পরে আজ শুক্রবার রায়ের দিন ধার্য করেছে ইসি। আইন অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিক হলে কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না।

শামীম নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব ত্যাগ করার যে নথিপত্র জমা দিয়েছেন, তা পর্যালোচনা করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল কাদের (এ. কে.) আজাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার মুস্তাফিজুর রহমান খান। তিনি সমকালকে বলেন, যে নথিগুলো শামীম হক জমা দিয়েছেন, তার সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাঁর নাগরিকত্বের অবস্থা জানতে এরই মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছে ইসি।

শামীম ইসির কাছে দাবি করেছেন, তিনি ৯ নভেম্বর নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব ত্যাগ করার আবেদন করেছেন। ৯ নভেম্বর তারিখে তাঁর সই করা একটি ঘোষণা ইসিতে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি কোথায়, কীভাবে এটি জমা দিয়েছেন– তার তথ্য উল্লেখ নেই। এটি নেদারল্যান্ডসের কাউন্সেলর কার্যালয় বা ঢাকায় তাদের দূতাবাস গ্রহণ করেছে– এমন কোনো সইও নেই।

পাশাপাশি শামীমের পক্ষে নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের নামে একটি ই-মেইলের কপি দেওয়া হয়েছে ইসিতে। তাতে বলা হয়েছে, শামীম নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব ত্যাগের ঘোষণা দিয়ে ‘হল্যান্ডস ফরেন মিনিস্ট্রি’তে আবেদন করেছেন। তবে নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম ‘মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স’। ই-মেইলে খুবই দুর্বল ইংরেজি ব্যবহার করা হয়েছে, যা কোনো বিদেশি দূতাবাস থেকে আশা করা যায় না।

নেদারল্যান্ডসকে আগে কেউ কেউ মৌখিকভাবে হল্যান্ড বললেও তা সরকারি নাম ছিল না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নেদারল্যান্ডস সরকার হল্যান্ড নামটির মৌখিক ব্যবহারকেও নিরুৎসাহিত করছে।

ফরিদপুরের দক্ষিণ আলীপুর ও ধুলধির স্থানীয়রা জানান, শামীম হক নেদারল্যান্ডসে থাকেন, তা সবাই জানে। কিন্তু তাঁর হয়ে যারা এসব জাল কাগজপত্র তৈরি করেছেন, তারা হয়তো জানেন না যে দেশটির নাম হল্যান্ড নয়; নেদারল্যান্ডস। ফলে ‘হল্যান্ডস ফরেন মিনিস্ট্রি’ থেকেই ভুলের সূত্রপাত। এ ক্ষেত্রে শিক্ষিত কাউকে দিয়ে করালে এত বড় ভুল হতো না বলে জানান স্থানীয়রা।

নাগরিকত্ব বাতিলের তথ্য দিয়ে শামীম ইসিতে যে নথি জমা দিয়েছেন, তাতে বিভিন্ন স্থানে বেশির ভাগ ই-মেইল যোগাযোগ হয় ৪ ডিসেম্বরের পরে। তবে প্রতিটি ই-মেইলে ৯ নভেম্বর নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়টি শামীমের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব ত্যাগ করার আবেদন করা নথি দূতাবাসসহ দায়িত্বশীল কারও গ্রহণ করার কোনো প্রমাণ নেই।

নথিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শামীমের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ই-মেইল করেছেন আলী আজগর মানিক নামে এক ব্যক্তি। মানিকের [email protected] অ্যাড্রেস থেকে করা ই-মেইলে নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসে যোগাযোগ করে শামীম হকের নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়টি বারবার তুলে ধরা হয়েছে। সেই ই-মেইলে ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের কনস্যুলার সেবার ঠিকানা, দূতাবাসের লোগো, ফোন নম্বর, ই-মেইল ও ওয়েবসাইটের ঠিকানা জালিয়াতি করে ব্যবহার করা হয়।
মানিকের ওই ই-মেইল থেকে খুঁজে পাওয়া যায় হল্যান্ড চিলড্রেন হাউস নামে একটি এতিমখানার ঠিকানা। সেখান থেকে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় মানিকের।

সমকালের পক্ষ থেকে গত বুধবার মানিকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি দূতাবাসের কোনো পদে কর্মরত রয়েছেন কিনা। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি ডাচ দূতাবাসে কাজ করব কেন? দূতাবাসের সঙ্গে আমাদের কিছু প্রকল্প রয়েছে, যেমন হল্যান্ড চিলড্রেন হাউস। এর ফলে দূতাবাসের সঙ্গে ই-মেইলে আমাদের যোগাযোগ হয়। আমি দূতাবাসের কোনো পদে নেই।’

ইসিতে জমা দেওয়া নথিতে ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের কনস্যুলার সেবার ঠিকানা, দূতাবাসের লোগো, ফোন নম্বর, ই-মেইল ও ওয়েবসাইটের ঠিকানা ব্যবহার করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের হল্যান্ড চিলড্রেন হাউসে দূতাবাসের কূটনীতিকসহ রাষ্ট্রদূত একাধিকবার এসেছেন। সে কারণে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো।’ তবে দূতাবাসের কোনো কিছু ব্যবহার করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

পরে নথির ছবি পাঠালে সেটি দেখে মানিক বলেন, ‘আমি এখন ফরিদপুরের বাইরে আছি। ফাইল নিয়ে বসে কথা বললে সুবিধা হতো।’

শামীমের নাগরিকত্ব নেদারল্যান্ডস বাতিল করে দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে মানিক বলেন, বাতিল হতে ১০-১১ মাস সময় লাগে। নাগরিকত্ব বাতিলের আবেদন ঢাকায় নেদারল্যান্ডস দূতাবাসে করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

দূতাবাসের নাম ব্যবহার করে মানিককে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগের নির্দেশ কে দিয়েছে– জানতে চাইলে শামীম বলেন, ‘আমিই তাঁকে বলেছি। যে ই-মেইল থেকে পাঠানো হয়েছে, তা আমার প্রতিষ্ঠানের।’

আরও পড়ুন

×