বাহারের ‘আশীর্বাদ’ নাকি নতুন ইতিহাস
কুমিল্লায় উত্তেজনা, নেতাকর্মী আরও বিভক্ত ময়মনসিংহে

.
জাহিদুর রহমান ও কামাল উদ্দিন, কুমিল্লা থেকে
প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৪ | ০০:২৯ | আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৪ | ০৬:৫২
ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে ভোট আজ শনিবার। কুমিল্লায় উপনির্বাচন হচ্ছে শুধু মেয়র পদে। দুটি নির্বাচনেই দলীয় প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। ময়মনসিংহে দলের একাধিক নেতা প্রার্থী হলেও ভোটারদের তেমন আগ্রহ নেই। তবে কুমিল্লায় বিরাজ করছে চরম উত্তেজনা, আছে সংঘাতের আশঙ্কাও। প্রশাসন বলছে, ভোট হবে শান্তিপূর্ণ
সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর হাতেই কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) দায়িত্ব থাকবে, নাকি ডা. তাহসিন বাহার সূচনা নগরীর উন্নয়নের ভার পাবেন– এ প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে নগরীতে। কেউ কেউ আবার মনে করছেন বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সারও চমক দেখাতে পারেন। নগরের আড়াই লাখ ভোটার আজ শনিবার এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন।
তবে ভোট নিয়ে পুরোনো স্মৃতি আবারও জেঁকে বসেছে স্থানীয়দের মনে। স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে ডা. সূচনা প্রার্থী হওয়ায় ভোট কতটা অবাধ ও সুষ্ঠু হবে, তা নিয়েই চলছে যত জল্পনাকল্পনা। ভোটের আগের রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি-ধমকি, অস্ত্র নিয়ে মহড়ায় আতঙ্ক ভর করেছে ভোটারদের মনে।
এ রকম পরিবেশে ভয় ও শঙ্কা নিয়েই নতুন মেয়র বেছে নিতে এক বছরের মাথায় উপনির্বাচনে আবারও ভোট দিচ্ছেন নগরবাসী। গোমতী নদীপাড়ের এই নগরের মানুষ যোগ্য ব্যক্তিকে নগরের অভিভাবক বানাতে মুখিয়ে আছেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতা ভোটযুদ্ধে আসায় দলের ভোটাররাও পড়েছেন অস্বস্তিতে, স্থানীয় রাজনীতিতে ভেঙে গেছে সব সম্প্রীতির বাঁধন। তবে নগরবাসীকে শান্তিপূর্ণ ভোট উপহার দিতে তৎপর প্রশাসন। এবার নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আগের তিন সিটি নির্বাচনে এমপি বাহারের আশীর্বাদপুষ্টরাই মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
গত নির্বাচনে বাহার তাঁর অনুসারী আরফানুল হক রিফাতের পক্ষে নেমেছিলেন কোমর বেঁধে। নির্বাচনী তিনিই জয়ী হন।
এবার বাহারের মেয়েই প্রার্থী হওয়ায় সব দৃশ্যপট বদলে গেছে। পুরো নগরে চলছে চাপা আতঙ্ক আর উদ্বেগ। শুরু থেকেই সংবর্ধনার আড়ালে মেয়ের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন বাহার। নির্বাচন কমিশনের বারবার সতর্কবার্তাও তিনি তোয়াক্কা করেননি। অভিযোগ রয়েছে, ভোটের দিন দুয়েক আগে মেয়েকে জেতাতে ছক সাজিয়েছেন তিনি।
একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিটি কেন্দ্রে ৩০০ জন করে কর্মী নিয়োগ দিয়েছেন এমপি বাহার। গত বৃহস্পতিবার প্রতিটি ওয়ার্ডে বৈঠক করেছেন এমপির লোকজন। ভোট শুরুর পর পরই অর্ধেকেরও বেশি কেন্দ্র থেকে অন্য প্রার্থীর এজেন্ট বের করে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিজের পক্ষের ভোটার ছাড়া অন্য কেউ যেন কেন্দ্রে না আসতে পারে, তা নিশ্চিত করতে একটি গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কৌশলে পথে পথে বাধা দেবে। নির্বাচনের দিন আতঙ্ক সৃষ্ট করে নারী ভোটারের অংশগ্রহণ কমাতে কাজ করবে আরেকটি গ্রুপ। এ ছাড়া গভীর রাতে বাহারের লোকজন দল বেঁধে প্রতিপক্ষ গ্রুপের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিচ্ছে।
হুমকির এ রকম একটি ভিডিও সমকালের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, আশ্রাফপুর এলাকায় বিএনপিকর্মী আবুল বাশারের বাড়িতে গিয়ে ২০-২৫ জনের একটি গ্রুপ দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। উচ্চৈঃ স্বরে চিৎকার করে একজন বলছে, ‘ভোটের দিন কেন্দ্রে গেলে খবর আছে।’ এ ছাড়া বুধবার রাতে সদর দক্ষিণ থানার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের রাজাপাড়া উত্তর চৌমুহনী এলাকায় মেয়র প্রার্থী কায়সারের কর্মী আনোয়ার হোসেনের ওপর হামলা হয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ সিটি নির্বাচনে কোনো প্রার্থীকে দলীয় প্রতীক দেয়নি। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের দুই নেতার পাশাপাশি বিএনপি ও স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে বহিষ্কৃত দুই নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদের জন্য লড়ছেন। বাস প্রতীক নিয়ে মাঠে আছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও কুমিল্লা সদরের এমপি বাহারের মেয়ে ডা. সূচনা। বিএনপির বহিষ্কৃত দু’বারের সাবেক মেয়র সাক্কু চতুর্থবারের মতো সিটি ভোটে লড়ছেন টেবিল ঘড়ি প্রতীকে। ঘোড়া প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার।
ডা. সূচনা ছাড়া বাকি তিনজনই এর আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। সাক্কু ২০২২ সালে রিফাতের কাছে মাত্র ৩৪৩ ভোটে হেরে যান। অবশ্য পরাজয়ের পেছনে কারচুপিকে দায়ী করেছেন তিনি।
কায়সার গত সিটি নির্বাচনে প্রায় ৩০ হাজার ভোট পেয়েছেন। অন্য প্রার্থী নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম ২০১২ সালে নির্বাচনে প্রায় ৮ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। এর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী চার মেয়র প্রার্থীর তিনজনেরই অভিযোগের তীর এমপি বাহারের দিকে।
মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মেয়র প্রার্থী তানিম বলেন, ভোটকেন্দ্রে মানুষ যেন আসতে না পারে, সে জন্য এমপি বাহার হুমকি দিচ্ছেন। আমরা তাঁকে কোনোভাবেই থামাতে পারছি না।
সাক্কু বলেন, কয়েক দিন ধরে প্রতি রাতেই এমপির পক্ষে ওয়ার্ডভিত্তিক নেতারা ঘরে ঘরে গিয়ে আমাদের কর্মীদের হুমকি দিচ্ছেন। কায়সার বলেন, ভোট লুটের চক্রান্ত চলছে।
কড়া নিরাপত্তা
২০২২ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া রিফাতের মৃত্যুতে এবার উপনির্বাচন হচ্ছে। আজ কুমিল্লা নগরীতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ভোট নির্বিঘ্ন করতে নগরীকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে। শুক্রবার সকালেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটের সরঞ্জাম পৌঁছে গেছে। এই সিটির ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫টি কেন্দ্রের ৬৪০টি বুথে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ করা হবে। কুমিল্লা জিলা স্কুল অডিটোরিয়াম থেকে ফলাফল প্রকাশ করা হবে।
এবার মোট ভোটার ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮ জন। তাদের মধ্যে ১ লাখ ১৮ হাজার ১৮২ পুরুষ ও ১ লাখ ২৪ হাজার ২৭৪ মহিলা এবং ২ জন হিজড়া।
গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে বন্ধ করা হয়েছে সব ধরনের প্রচারণা। অধিকতর সতর্কতার অংশ হিসেবে এ নির্বাচনের সব কেন্দ্রই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করে পুলিশ-আনসারের বাড়তি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। ভোটারদের যাতায়াতের পথেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য এবং ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন করা হয়েছে। প্রভাব বিস্তার হলে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান বলেন, কেউ নাশকতা করার চেষ্টা করলে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ভোটের দিন প্রতি কেন্দ্রে ৫ জন করে অস্ত্রধারী পুলিশ এবং সশস্ত্র ২ জনসহ ১২ জন আনসার নিয়োজিত থাকবে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে ২৭টি ওয়ার্ডে পুলিশের ২৭টি মোবাইল টিম, ৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে একটি করে স্ট্রাইকিং ফোর্সের টিম থাকবে এবং রিজার্ভ হিসেবে থাকবে ২টি স্ট্রাইকিং টিম।
জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান জানান, শুক্রবার থেকে ৯ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ২৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ১২ প্লাটুন বিজিবি ও র্যাবের ২৭টি টিম মাঠে কাজ শুরু করেছে। ভোটের মাঠের পরিবেশ এখনও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এমন ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে নগরবাসীকে একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দেওয়া যাবে।
রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন বলেন, কোথাও গোলযোগ কিংবা বিশৃঙ্খলা হলে ৫ মিনিটের মধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। ফলাফলে স্বচ্ছতা আনতে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে ইভিএম মেশিন থেকে প্রিন্ট দিয়ে এজেন্টদের হাতে ফলাফল সরবরাহ করা হবে।
কে কোথায় ভোট দেবেন
ডা. সূচনা সকাল ৯টার দিকে ভোট দেবেন রানীর দিঘিরপাড়ের ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজিয়েট স্কুল কেন্দ্রে। সকাল ১০টার দিকে উত্তর চর্থা এলাকার নবাব হোচ্ছাম হায়াদার উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার কথা সাক্কুর। ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শাখা কেন্দ্রে সকাল ৮টার দিকে ভোট দেবেন কায়সার। তানিম সকাল ৯টার দিকে ভোট দেবেন ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজিয়েট স্কুল কেন্দ্রে।
- বিষয় :
- ভোট
- সিটি নির্বাচন