আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে পরিকল্পনার ঘাটতি
একাত্তরে গণহত্যা

ফাইল ছবি
আবু সালেহ রনি
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৪ | ০৬:৩২
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি নিধনে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা বা জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সমন্বিত পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় কোন প্রক্রিয়ায় স্বীকৃতি আদায়ের দাবি জাতিসংঘে উত্থাপন করা হবে– এমন কোনো নীতি বা পরিকল্পনাও চূড়ান্ত হয়নি। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি ২০২২ ও ২০২৩ সালে কিছু উদ্যোগ নিলেও পরে তাদের আর কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কাজেও রয়েছে সমন্বয়হীনতা।
দেশে গত ৭ বছর ধরে গণহত্যা দিবস জাতীয়ভাবে পালন হলেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সরকারের তৎপরতা কার্যত থমকে আছে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষকসহ বিশিষ্টজনরা মনে করেন, জাতিসংঘে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের প্রস্তাব উত্থাপনে যথেষ্ট বিলম্ব হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকায় অনেক দেশ বাংলাদেশে গণহত্যা বিষয়টিই মানতে চায় না। কিন্তু ইতিহাসের সত্যকে এড়ানোর সুযোগ নেই। গণহত্যার অসংখ্য তথ্য-উপাত্ত এখনও বিরাজমান। এর ভিত্তিতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে উদ্যোগ নিলে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব। এ জন্য দেশে-বিদেশে বৃহৎ পরিসরে প্রচারণার দিকেও জোর দিতে হবে।
বিশিষ্টজনদের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য সুষ্ঠু সমন্বয় দরকার। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মধ্যে সমন্বয় দরকার। মন্ত্রণালয়ে কথা বলব এটি নিয়ে কী করা যায়।’
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ৫৩ বছর আগের ঘটনা, সে জন্য যথোপযুক্ত ডকুমেন্টেশন অত্যন্ত জরুরি। ভিজুয়াল ডকুমেন্টেশন আমাদের বেশি নেই এবং মুক্তিযোদ্ধারা দিন দিন মারা যাওয়ায় তাদের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। তাই এই ডকুমেন্টেশন করতেই হবে আমাদের এবং দ্রুত করতে হবে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টি জোরদার করতে এরই মধ্যে একটি সেল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগির এর কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা।
গণহত্যা সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশি তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, তা ছিল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম নৃশংস গণহত্যা। তখন প্রায় ৩০ লাখ শহীদ হন। স্বাধীনতার পর থেকেই গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, গণহত্যা জাদুঘরসহ নানা সংগঠনের প্রচেষ্টায় গত কয়েক দশকে গণহত্যার স্বীকৃতির দাবি জোরালো হয়। বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষও গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে দেশে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ১১ মার্চ সংসদে সর্বসম্মতভাবে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করা হয়। এর পর ওই বছর স্বীকৃতি আদায়ে কিছু উদ্যোগ নিলেও পরে আর তার ধারাবাহিকতা অনুসরণ করা হয়নি। বর্তমানে জাতীয়ভাবে দেশে গণহত্যা দিবস পালনের মধ্যেই এই কার্যক্রম আপাতত সীমাবদ্ধ।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সমকালকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরির কাজ চলছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও কূটনৈতিক পর্যায়ে কাজ করছে। বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে কিছু উদ্যোগ নিলেও তাতে সরকার সহায়তা করছে। পরিস্থিতি অনুকূলে এলে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের প্রস্তাব জাতিসংঘে উপস্থাপন করা হবে।
বেসরকারি প্রচেষ্টা
সরকারের প্রচেষ্টা থমকে থাকলেও শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে তৌহীদ রেজা নূরের উদ্যোগে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রথম গণহত্যার এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি মেলে। এদিন মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন। তারই উদ্যোগে ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জেনোসাইড ওয়াচ এবং ২০২৩ সালের ২৬ এপ্রিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স (আইজিএস) বাংলাদেশে গণহত্যার পৃথক স্বীকৃতি দেয়।
গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চেয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে পৃথক স্মারকলিপি দিয়েছিল আমরা একাত্তরসহ বেসরকারি কয়েকটি সংগঠন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে গণহত্যা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ ভবনে সেমিনারও আয়োজন করা হয়। একই বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতির দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদেও প্রস্তাব তোলা হয়।
দেশটির দুই আইনপ্রণেতা ‘বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতি’ শীর্ষক ৮ পৃষ্ঠার ওই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। মার্কিন কংগ্রেসে প্রস্তাবটি উত্থাপন ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে ছিল।
তৌহীদ রেজা নূর বর্তমানে জেনোসাইড বিষয়ে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণার কাজে যুক্তরাষ্ট্র রয়েছেন। জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, ‘গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে নানামুখী উদ্যোগ দরকার। কিন্তু রাষ্ট্রের দিক থেকে এর অনুপস্থিতি আছে। সরকারের তরফ থেকে গণহত্যার ডকুমেন্টগুলো জাতিসংঘসহ সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে পাঠানো দরকার, যেটা জনমত গঠনে সহায়ক হবে।’
তিনি বলেন, সরকারকেই গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। এজন্য অবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, সুশীল সমাজ, গণহত্যার শিকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও আন্তর্জাতিক গণহত্যা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সরকারের উদ্যোগে স্বীকৃতি আদায়ের সমন্বিত পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, ‘জেনোসাইডের অপরাধ কখনও তামাদি হয় না। ১৯৭১ সালে সংগঠিত জেনোসাইডের অজস্র প্রমাণ ও তথ্য রয়েছে। এগুলো সরকারিভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপনের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিত্তিতে এগোতে হবে।’
বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক শাহরিয়ার কবির সমকালকে বলেন, সরকারিভাবে কোনো অগ্রগতি নেই। বেসরকারি উদ্যোগেই যা কিছু হয়েছে। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি সেল গঠন করার কথা বলেছেন। আশা করছি, সরকারের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকজনের সম্মিলিত উদ্যোগ থাকলে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হবে। তাঁর মতে, জনগত গঠন করে জাতিসংঘের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এর সঙ্গে ভারতসহ মিত্র দেশগুলোকেও আমাদের পক্ষে লবিং করার জন্য রাখতে হবে।
- বিষয় :
- গণহত্যা
- গণহত্যা দিবস