ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সংসদীয় কমিটির দু’নয়ন ‘নিজ এলাকার উন্নয়ন’

সংসদীয় কমিটির দু’নয়ন ‘নিজ এলাকার উন্নয়ন’

ছবি-সমকাল

 মসিউর রহমান খান

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪ | ০১:৩৯ | আপডেট: ১৭ মে ২০২৪ | ১০:৩৫

নিজের এলাকার ‘উন্নয়ন’ আগে, পরে দেশের চিন্তা! এমন ব্যক্তিস্বার্থের বৃত্ত থেকে যেন বেরই হতে পারছেন না জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্ত কিংবা সুপারিশের ক্ষেত্রে জনস্বার্থকে পাশ কাটানো হচ্ছে। এসব সুপারিশে কমিটি সদস্যদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং দপ্তর এ ধরনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজেদের জবাবদিহির বাইরে রাখার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাহী বিভাগের (সরকার) কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করা কমিটির প্রধান কাজ হলেও নিজ নির্বাচনী এলাকার বাইরে যেন চোখ মেলতে রাজি নন তারা। 

দশম ও একাদশ সংসদের ধারাবাহিকতায় এবারের কমিটিগুলোর কার্যক্রমেও ব্যক্তিস্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এই যেমন– দ্বাদশ জাতীয় সংসদের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রথম বৈঠকের চার সুপারিশের তিনটিই কমিটি সদস্যদের নিজ নির্বাচনী এলাকা ঘিরে। 

‘কমিটি সদস্যের নির্বাচনী এলাকায় পর্যায়ক্রমে একটি করে ব্যায়ামাগার ও সুইমিংপুল নির্মাণের উদ্যোগ’ এবং ‘কমিটির যে সদস্যদের নির্বাচনী এলাকায় শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম নেই, সেখানে তা নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ’– চার সুপারিশের মধ্যে এ দুটি উল্লেখযোগ্য। এর বাইরে আরেকটি সুপারিশ ছিল নাটোর সদর ও নলডাঙ্গায় শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করা। ১০ সদস্যের এই কমিটির একজন নাটোর-২ (সদর ও নলডাঙ্গা) আসনের এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুল। এ ব্যাপারে এমপি শিমুল বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকা শুধু নয়, অন্য নির্বাচনী এলাকায়ও স্টেডিয়াম নির্মাণের কাজ চলছে। অনেক জায়গায় স্টেডিয়াম চালু হয়ে গেছে।’ কমিটির সদস্যদের শুধু নিজ এলাকার কাজের জন্য সুপারিশ করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অন্য এমপির সমস্যা হলে আমাদের জানালে সে বিষয়েও কমিটি কথা বলবে। কমিটি চাইলে মন্ত্রণালয়ের সব কাজের বিষয়েই পর্যালোচনা ও সুপারিশ করতে পারে।’ তাহলে কেন শুধু কমিটি সদস্যদের নির্বাচনী এলাকা নিয়ে সুপারিশ করা হয়– এমন প্রশ্নের শিমুল বলেন, ‘এই কমিটির সভাপতি আগে এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তাই এসব বিষয় তাঁর নখদর্পণে।’

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি জাহিদ আহসান রাসেল। তিনি একাদশ সংসদে একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সংসদীয় কমিটির সদস্যরা এভাবে মন্ত্রণালয় থেকে নিজ নির্বাচনী এলাকার জন্য কাজ বাগিয়ে নেওয়ার তৎপরতায় থাকলে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়ে ব্যাঘাত ঘটবেই। কারণ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যখন কমিটির সদস্যের নির্বাচনী এলাকায় বিশেষ সুবিধা দেবে, তখন ওই মন্ত্রণালয়ের কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে তিনি আর প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। এ ধরনের সুপারিশে জনস্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। 

তিনি বলেন, ‘যে কোনো উন্নয়ন কার্যক্রমের সুপারিশ হতে হবে বৈষম্যহীন বা সর্বজনীন। এ ধরনের সুপারিশের মাধ্যমে স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং দলীয়করণের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমে কমিটি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে সদস্যরা নিজ স্বার্থে এ সুযোগকে ব্যবহারে সচেষ্ট হচ্ছেন। জনস্বার্থে এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’ 

সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এর আগে একাদশ সংসদের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একটি সুপারিশ ছিল, ‘‌বাংলাদেশ রেলওয়ের যে ৫৫টি স্টেশন সংস্কার করা হয়েছে, তা স্থানীয় সংসদ সদস্যের মাধ্যমে ২০২৩ সালের অক্টোবরে উদ্বোধন করতে হবে।’ এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং সংসদবিষয়ক গবেষক নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, রেলস্টেশনগুলোর সংস্কারকাজ সঠিকভাবে হয়েছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখা কমিটির কাজ। স্থানীয় এমপির মাধ্যমে এগুলোর উদ্বোধন হবে, নাকি অন্য কেউ উদ্বোধন করবে, সেটা সুপারিশ করা রীতিমতো হাস্যকর। 

একইভাবে দশম সংসদে ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সুপারিশে ‘কমিটির সদস্যদের পছন্দে পাঁচজন করে সরকারি খরচে হজে পাঠানোর জন্য বলা হয়।’ এমনকি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান মঞ্চে সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের বসার স্থান কোথায় হবে– তা নির্ধারণ করে দিয়ে সুপারিশের নজিরও রয়েছে। এ ব্যাপারে নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা কখনোই তেমন একটা হতে দেখা যায়নি। দশম সংসদ থেকে এ পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়েছে। আগে প্রতিটি কমিটিতে একজন করে বিরোধী দলের সদস্য ছিল। এখন পুরো সংসদেই বিরোধী দলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। ফলে সংসদ নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। তিনি বলেন, কমিটিতে থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজের তদারকি করার মতো মানসিকতাও এখন আর সদস্যদের মধ্যে চোখে পড়ে না। এসব সুপারিশ দেখে মনে হয়, নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে আইন সভার কাজের পার্থক্যই এমপিরা বোঝেন না বা পার্থক্য করতে চান না। 

বর্তমান সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে জানুয়ারিতে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই ৫০টি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটিগুলোর ১৪টির সভাপতি করা হয়েছে আগের সংসদের মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীকে। এর মধ্যে আটটি মন্ত্রণালয়ের সভাপতি পদে রয়েছেন আগের সরকারের একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। যদিও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির সর্বশেষ ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে একাদশ সংসদ সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘অধিকাংশ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যক্রমে ঘাটতি লক্ষণীয় ছিল। দশম সংসদের কয়েকজন মন্ত্রীকে একাদশ সংসদে একই মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে সদস্য এবং সভাপতি করা হয়েছে, যা স্বার্থের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। সর্বোপরি সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করার সুযোগ থাকলেও তা প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর ছিল না।’

সংসদ সচিবালয়ের সূত্র জানিয়েছে, একাদশ সংসদে ৫০ কমিটির মধ্যে বিরোধী দল থেকে সভাপতি ছিল চার কমিটিতে। এবার শুধু সরকারি হিসাব সম্পর্কিত কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাতীয় পার্টির এমপি হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদকে। একাদশ সংসদের ৩৩ কমিটিতে ন্যূনতম একজন বিরোধী দল থেকে সদস্য রাখা হয়েছিল। এবার বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্য সংখ্যা মাত্র ১৩। স্বতন্ত্র হিসেবে ৬২ এমপির সবাই অনানুষ্ঠানিক আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তবে স্বতন্ত্র এমপির মধ্যে মাত্র একজন সিলেট-৫ আসনের হুছামুদ্দীন চৌধুরীকে ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। 

সংসদ সচিবালয়ের হিসাব অনুযায়ী, মার্চে ২৫টি সংসদীয় কমিটি ২৬টি বৈঠক করেছে। আর এপ্রিলে ৩০টি কমিটির ৩৪টি বৈঠক হয়েছে। যদিও কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী প্রতিটি কমিটিকে মাসে ন্যূনতম একটি বৈঠকের বাধ্যবাধকতা আছে। এর মধ্যে বেশ কিছু সুপারিশ এসেছে কমিটি সদস্যদের নিজ নির্বাচনী এলাকার বিষয়ে। 

এ ছাড়া ২৫ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি রাঙামাটি গিয়ে বৈঠক করেছে। রাঙামাটি জেলা পরিষদ সম্মেলন কক্ষে ওই বৈঠকে পাহাড়ের অশান্ত পরিস্থিতি নিয়ে তারা কোনো আলোচনাই করেননি। কমিটির সভাপতি বীর বাহাদুর উ শৈ সিং দাবি করেন, এগুলো সংসদীয় কমিটির কাজ নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ।

অকার্যকর পিটিশন কমিটি

পিটিশন কমিটির মাধ্যমে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণের সরাসরি অভিযোগ করার সুযোগ থাকলেও প্রচারণার ঘাটতির কারণে তা অকার্যকর। সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণ মানুষকে সংসদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করতেই এ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৫ সালের মে মাসে দশম সংসদে এ কমিটির একটি বৈঠক হয়েছিল, তাও প্রায় ১০ বছর পর। এর পর আর বৈঠকের খবর পাওয়া যায়নি। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি কোনো বিষয়ে প্রচলিত আইনে প্রতিকার না পেলে তিনি সংসদের কাছে পিটিশন জমা দিতে পারবেন। সংসদ সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালে অষ্টম সংসদে পিটিশন কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বিকল্প রাস্তা তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত সাতক্ষীরা টিভি সম্প্রচার কেন্দ্রের মাঝখানের রাস্তাটি জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল।

এ কমিটির সভাপতি স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। কমিটিকে কার্যকর করার বিষয়ে তিনি ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও ২০১৫ সালের পর আর কোনো বৈঠক করা সম্ভব হয়নি। কার্যপ্রণালি বিধিতে উল্লেখিত নির্দিষ্ট শর্ত মেনে দেশের যে কোনো নাগরিক একজন সংসদ সদস্যের অনুস্বাক্ষরে এ কমিটিতে আবেদনের সুযোগ রয়েছে। তবে একাদশ ও দ্বাদশ সংসদে কোনো আবেদনই জমা পড়েনি। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর মতে, মানুষ কোন কোন বিষয়ে প্রতিকার পাওয়ার জন্য পিটিশন কমিটিতে আবেদন করতে পারবে, সে বিষয়গুলো কার্যপ্রণালি বিধিতে স্পষ্ট নয়।

আরও পড়ুন

×