মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা কর্মীর কী হবে

টিকেট না পেয়েও মালয়েশিয়া যাওয়ার শেষ দিন বিমানবন্দরে ভিড় করেন অনেকে - ফাইল ছবি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৪ | ০৭:২৩
সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও যেসব কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি, তাদের জন্য আশাবাদী হওয়ার মতো খবর নেই। কাদের ব্যর্থতায় কর্মীরা দেশটিতে যেতে পারেননি, তা খুঁজতে তদন্ত কমিটি করেছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। তবে যেতে না পারা কর্মীরা ‘টাকা ফেরত পাবেন’– এমন কথা মন্ত্রণালয় জোর দিয়ে বলছে না।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সিন্ডিকেটের অনিয়ম এবং তাতে প্রভাবশালী এমপিদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী গতকাল রোববার রাজধানীর ইস্কাটনে প্রবাসীকল্যাণ ভবনে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘তদন্ত করা হবে। রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক এমপি না কে, তা আমরা জানি না। কোনো এমপিকে চিনি না, দায়ী যেই হোক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, কর্মীরা কেন মালয়েশিয়া যেতে পারেননি, সেই কারণ অনুসন্ধান করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি। আগামী বুধবার মালয়েশিয়ার হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠক হবে। যেতে না পারা কর্মীদের দেশটিতে প্রবেশের সুযোগ দিতে অনুরোধ করা হবে।
গত শুক্রবার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে। হাজার হাজার বাংলাদেশি কর্মী রিক্রুটিং এজেন্সি ও আদম ব্যবসায়ীর কাছে টাকা দিয়েও দেশটিতে যেতে পারেননি। শুক্রবার শেষ দিনে বিমানের টিকিট না পেয়ে বিমানবন্দরে ভিড় করা হাজারো মানুষ আহাজারি করেন।
কর্মীরা জানান, সরকার মালয়েশিয়া যাওয়ার খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করলেও তাদের কাছ থেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। জমি বিক্রি করে, সুদে ঋণ নিয়ে টাকা দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন তারা।
এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীরা কীভাবে টাকা ফেরত পাবেন, তা স্পষ্ট করেননি প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ও সচিব। সচিব রুহুল আমিন বলেছেন, তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ জানাতে পারবেন কর্মীরা।
কর্মী ও এজেন্সির চুক্তিপত্রে সরকার নির্ধারিত ব্যয় উল্লেখ থাকে। কর্মীর কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করা হয় বিনা রসিদে। এই টাকা কর্মীরা কীভাবে ফেরত পাবে– এমন প্রশ্নে সচিব বলেন, তদন্ত কমিটি বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। যত টাকা নেওয়া হয়েছে, তা ফেরত দিতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠন বায়রা এর দায়িত্ব নিয়েছে।
যদিও জনশক্তি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাড়তি টাকার বড় অংশ চলে গেছে সিন্ডিকেটের পকেটে এবং মালয়েশিয়ায়। ফলে টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মালয়েশিয়া থেকে আসা ৫ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৩ চাহিদাপত্রের বিপরীতে গত ৩১ মে পর্যন্ত জনশক্তি কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ জনকে ছাড়পত্র দেয়। তাদের মধ্যে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ জন মালয়েশিয়া গেছেন। ১৬ হাজার ৯৭০ কর্মী যেতে পারেননি।
জনশক্তি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বায়রার মতে, কর্মীদের মধ্যে ৫ হাজার ৯৫৩ জন শুধু বিমানের টিকিট না পাওয়ায় যেতে পারেননি। বাকি ১১ হাজার যেতে পারেননি বিভিন্ন কারণে। প্রতিমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এখনও বায়রার তালিকা তিনি পাননি। গত ১৪ মে বৈঠক করে তালিকা চাওয়া হয়েছিল।
জনশক্তি ব্যবসায়ী ও হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিমানের টিকিটের জন্য যেতে না পারা ৬ হাজার কর্মীর সবাই ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা করে দিয়েছেন। ছাড়পত্র পাওয়া বাকিরা বিমান ভাড়া বাদে বাকি টাকা দিয়েছেন আদম ব্যবসায়ী ও এজেন্সিকে। এর বাইরে গ্রামে-গঞ্জে হাজারো মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নিয়েছে তারা। ফলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি।
কর্মীদের পাঠাতে মন্ত্রণালয় আন্তরিক ছিল না, ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হয়নি– এসব অভিযোগের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে সরকার বরাবরই আন্তরিক ছিল। অতিরিক্ত ২৩টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে।
গত ১৫ বছরে তিনবার বন্ধ হয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। ২০১৫ সালে ১০ বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি সিন্ডিকেট ২ লাখ ৭৮ হাজার কর্মী পাঠিয়েছিল। এতে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে শ্রমবাজার বন্ধ হয়।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর ২৫ এজেন্সির সিন্ডিকেট কর্মী পাঠানোর কাজ পায়। পরে যুক্ত হয় আরও ৭৫ বেসরকারি এজেন্সি। প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান বলেন, নিয়োগকারী দেশ চায় বলেই সিন্ডিকেট হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার সিন্ডিকেটে বিশ্বাস করে না। সব এজেন্সি যেন কর্মী পাঠাতে পারে, এটাই চায় সরকার।
সমকালের অনুসন্ধান অনুযায়ী, সিন্ডিকেটের চাঁদা এবং ভিসা কেনা বাবদ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। প্রত্যেক কর্মীর জন্য সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রকরা নেয় ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা। দেড় লাখ টাকায় ভিসা ‘কিনে’ ভুয়া চাকরিতে কর্মী পাঠানো হয়েছে। বহু কর্মী মালয়েশিয়ায় গিয়ে চাকরি পাননি। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা তা জানিয়েছে। তবে সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসীকল্যাণ সচিব রুহুল আমিন বলেন, সম্প্রতি মালয়েশিয়া নামার পর কোনো কর্মীকে নিয়োগকারী গ্রহণ করেনি, এমন ঘটনা নেই।