ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সীমান্ত দিয়ে আসছে নকল ফেনসিডিল

সীমান্ত দিয়ে আসছে নকল ফেনসিডিল

ইনফোগ্রাফিক্স- সমকাল

লিমন বাসার, উত্তরাঞ্চল

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৪ | ২৩:৫৯ | আপডেট: ১৬ জুন ২০২৪ | ০৬:৩৫

দুই দেশের সীমান্ত বরাবর অনেক স্থানে নেই কাঁটাতার। বাংলাদেশের যে ক’টি বিজিবির তল্লাশিচৌকি আছে, সেগুলোর অধিকাংশই ফাঁকা। যে কেউ ইচ্ছা করলে হাঁটাপথে বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে যখন-তখন ভারতে ঢুকতে ও বের হতে পারবে। জয়পুরহাটের চেঁচড়া সীমান্তের ওপারে ভারতের উচাই গ্রাম। সে গ্রামের আলোচিত চরিত্র কালাচাঁদ। মানুষটি দেখতে খর্বকায় হলেও ক্ষমতার হাত বেশ লম্বা। শুক্রবার রাতে অন্ধকার মাড়িয়ে নিয়ে চললেন গ্রামের এক বাড়ির দিকে। অচেনা গাছের ঝোপঝাড় মাড়িয়ে ২০ মিনিটেই পৌঁছা গেল ভারতের সে গন্তব্যে। বাড়িতে ঢুকতেই নাকে লাগল ফেনসিডিলের উৎকট গন্ধ। দেখা গেল, গোটা বিশেক প্লাস্টিক বালতির মধ্যে তরল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে কয়েকজন। এ তরলই ফেনসিডিল। রাত ১০টার পর থেকে বোতলে ফেনসিডিল মজুতের কাজ চলছে। রাত সাড়ে ৩টার মধ্যে চোরাই পথে এসব চালান দেওয়া হবে বাংলাদেশে।

কালাচাঁদ জানান, আসল ফেনসিডিল ছাড়াও তাদের কাছে কফিডিল, ফায়ারডিল ও এমকেডিল আছে। লোকজন বুঝে তারা এসব ডেলিভারি করেন। এই ঈদে শতকোটি টাকার মাদকের চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশে। যে যেমন টাকা দেবে, তেমন মাদক পাবে। কেউ ফেরত যাবে না। আসল বোতল টোকাইদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে তাতে ছাপানো লেবেল লাগানো হয়। এর পর সেই বোতলে তোলা হয় ঘুমের ট্যাবলেট, কফ সিরাপ, চা পাতা, গুড় আর অজানা রাসায়নিকমিশ্রিত এসব নকল ফেনসিডিল। যন্ত্রের মাধ্যমে বোতলের মুখে আসল ক্যাপ লাগানো হয় বিশেষ কায়দায়। কারও বোঝার উপায় নেই, এটি নকল। ফেনসিডিল বিক্রির জন্য ভারতে শখানেক পরিবেশক নিয়োগ করা আছে। তাদের মধ্যে ত্রিমোহিনীর দত্ত বাবু, তাঁর ছেলে নেপাল বাবু ও গোপাল, কালিকাপুরের মোজাফফর রহমান অন্যতম।

এক মাদক কারবারি বলেন, ফেনসিডিলের পুরোনো একটি বোতলের দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা। নতুন একটি মুখ (ছিপি)-এর দাম খুবই সামান্য। এর মধ্যে নকল সরঞ্জাম মিশিয়ে ফেনসিডিল তৈরি করতে তাদের ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা খরচ হয়।

উচাই গ্রামের বেশির ভাগ টিনের বাড়ির চারপাশে দেখা যায় অসংখ্য ছিদ্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব ছিদ্র নিরাপত্তার কারণে। দূর থেকে দেখে বিপদ সম্পর্কে আগে থেকেই টের পাওয়া যায়। কালাচাঁদ জানান, এ রকমের আরও ১২টি বাড়ি (কারখানা) রয়েছে তাঁর নিজের। এ ছাড়া আশপাশের আরও অন্তত ৫০টির বেশি বাড়িতে একইভাবে তৈরি হয় ফেনসিডিল। প্রতি রাতে নির্দিষ্ট সময়ে এসব পাচারের জন্য পাঠানো হয়। পাচার চক্রের অন্যতম নিয়ন্ত্রক এলাকার শন্তু ভৌমিক, টুম্পা ভৌমিক, অনিল কুমার, বসাক ও এনামুল নামের পাঁচ কারবারি।

চেঁচড়া সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে মাদক কারবারি আনিস। তার দলে আছে ছোট মিজান, আল আমিন, রিয়াজ ওরফে কালু, সিনবাদ, সুরুজ, রাব্বি, নাহিদ, রিজু ও শাকিল। এখানে এ গ্রুপের পাশাপাশি আরও একটি গ্রুপ সক্রিয়। সেটির নেতৃত্বে আছে হৃদয়। তার সহযোগী বড় মিজান।

চেঁচড়া সীমান্তে বিজিবির চেকপোস্টের সঙ্গে লাগোয়া দোতলা বাড়ি করেছে মাদক কারবারি রুবেল। তার সঙ্গে আছে জুয়েল, মাহাতাব, হিরো ও জিয়া। আর পাশের উত্তর গোপালপুরে মাদক ও চোরাচালান সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক হলো এনামুল। এ গ্রুপটিই উচাই সীমান্ত দিয়ে ভারতের ঘুনাপাড়া ও ঘোসাইপুর গ্রাম থেকে প্রতি রাতে মাদক বাংলাদেশে নিয়ে আসে। এ তালিকায় নতুন নাম যোগ হয়েছে হেরোইন।

ইউপি সদস্যের নিয়ন্ত্রণে সীমান্ত

দিনাজপুরের বিরামপুর থানার সীমানাসংলগ্ন ঘাসুরিয়া এলাকায় শাখা যমুনা নদী পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে মাদক। তবে এখান দিয়ে আসা মাদকের ৮০ শতাংশই আসে কাটলা সীমান্ত দিয়ে। অন্যদিকে হিলির উত্তর গোপালপুর, জিলাপিপট্টি, ফুটবল খেলার মাঠ, কালীবাড়ি, রেলওয়ের পিডব্লিউ এলাকা, চেকপোস্ট গেট, ধরন্দা, বাসুদেবপুর বিজিবি ক্যাম্পের অধীনে হিন্দু মিশন, হাঁড়িপুকুর, মোংলা বিশেষ ক্যাম্পের অধীনে রাইভাগ, নন্দীপুর, ঘাসুড়িয়া ও মোংলা সীমান্তও নকল ফেনসিডিল আসার অন্যতম রুট।

অনুসন্ধান করে জানা গেছে, বিরামপুরের মাদক কারবারের ‘গডফাদার’ কাটলা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য একরামুল হক, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মইনুল ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শুকুর আলী। বিরামপুর সীমান্তে মাদক চোরাচালান কারবার নিয়ন্ত্রণ করে তারা।

ভারতীয় পয়েন্ট ও হোতা যারা

মাদক কারবারির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নকল ফেনসিডিল তৈরির কারখানার মধ্যে ত্রিপুরার সোনামুরা বাজারের তিনটির মালিক হলো প্রবাল সাহা, মিহির আলী ও সেলিম মিয়া। সীমান্তের জিরো পয়েন্ট থেকে এ তিন কারখানার দূরত্ব মাত্র ৪০০ মিটার। এ ছাড়া ত্রিপুরার বিকাশনগর (আজিমপুর) ও মধুপুর পাহাড়ি এলাকাসহ পশ্চিম ত্রিপুরার গান্ধীগ্রাম ও আগরতলায় রয়েছে একাধিক কারখানা। মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর, ডাকবাংলো বাজার ও ধুলিয়ান বাজারের কারখানার মালিক যথাক্রমে সুখচাঁদ চন্দ, অনু মোদি ও বাদল। গ্রামগুলো বাংলাদেশের সীমান্তের সবচেয়ে কাছের। ভারতের ব্যবসায়ীর সঙ্গে বাংলাদেশের আতিয়ার রহমান, নজির উদ্দিন, আশরাফুল, মাহবুব, নজরুল ওপারে গিয়ে যৌথ মূলধনে কারবার পরিচালনা করে থাকে।

আরও পড়ুন

×