ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে কী পাবে বাংলাদেশ

ফাইল ছবি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪ | ০১:১১ | আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪ | ০৭:৩৪
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে সই হওয়া সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়নে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতীয় ট্রেনের পরীক্ষামূলক যাত্রা হতে পারে। এর আগে দুই দেশের প্রতিনিধিদের একটি কমিটি হবে। তারা ট্রেন চলাচলের স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) নির্ধারণ করবে। এরপর ভারতীয় ট্রেনের সময়সূচি এবং ট্যারিফ নির্ধারণ হবে। রেল ভবন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের ট্রেন পরিচালনার এ সুবিধাকে নথিপত্রে দুই দেশের কানেক্টিভিটি বলা হলেও এটি ট্রানজিট নামে পরিচিতি পেয়েছে। ভারতকে দেওয়া এ সুবিধার বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পাবে– তা নিয়ে রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীর সমকালকে বলেন, ভারতের রেলপথ ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটান যাওয়ার সুবিধা পাওয়া যাবে। তবে রেলের একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে জানিয়েছেন, ওই দুই দেশের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তির আওতায় এ সুবিধা আগে থেকেই রয়েছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছর পর্যন্ত নেপালে সার রপ্তানি হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনুমতি না দেওয়ায় দুই বছর ধরে তা বন্ধ। আর ভুটানে রেলপথ না থাকায় ট্রানজিট সুবিধা কখনও ব্যবহার হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার গেদে থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রাজ্যটির আলিপুরদুয়ার জেলার ডালগাঁও পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রেন চালানোর প্রস্তাব দিয়েছিল ভারতের রেল বোর্ড। সে অনুযায়ী, পরীক্ষামূলক যাত্রায় পণ্যশূন্য ভারতীয় রেলগাড়ি গেদে থেকে বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় আসবে। সেখান থেকে পাবনার ঈশ্বরদী, নাটোরের আব্দুলপুর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, নীলফামারী সীমান্তবর্তী চিলাহাটী স্টেশন হয়ে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ী স্টেশনে যাবে। সেখান থেকে যাবে ডালগাঁও স্টেশন পর্যন্ত। ডালগাঁওকে ভুটান সীমান্তবর্তী স্টেশন বলেছিল ভারত। যদিও সেখান থেকে ভুটানের ফুয়েন্টশিলং স্থলবন্দরের দূরত্ব শত কিলোমিটারের বেশি।
আর বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রস্তাব ছিল, ভারতীয় রেল বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ডালগাঁও নয়, সেখান থেকে জয়পুর হয়ে ভুটান সীমান্তবর্তী হাসিমারা পর্যন্ত যাক। এ বিষয়ে রেল সচিব জানান, সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ভারতীয় ট্রেন হাসিমারা পর্যন্ত যাবে। এর মাধ্যমে ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত পাঁচটি রুটে ট্রেন চলে। এর মধ্যে তিনটি যাত্রীবাহী ইন্টারচেঞ্জ; বাকি দুটি পণ্যবাহী। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, রাজশাহী-কলকাতা রুটে আরেকটি ট্রেন চালু হবে।
এখনকার পদ্ধতিতে ভারতীয় ট্রেন সীমান্তে আসার পর বাংলাদেশি ইঞ্জিনে ভেতরে আসে। বাংলাদেশি লোকোমাস্টার (চালক) তা চালিয়ে আনেন। ফিরে যাওয়ার সময়েও একই রকম নিয়ম অনুসরণ করা হয়। রেল সূত্র জানিয়েছে, গত ২২ জুন সই হওয়া স্মারক অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রেন চালানো সুবিধা পেলেও আগের প্রক্রিয়াতেই চলবে। কারণ, দুই দেশের রেল পরিচালনা পদ্ধতি ভিন্ন।
এদিকে দর্শনা থেকে চিলাহাটী রেলপথটি বাংলাদেশ রেলের অন্যতম ব্যস্ত সেকশন। এ পথে সক্ষমতার চেয়ে বেশি ট্রেন চলে। ভারতীয় ঋণে (এলওসি) নির্মাণাধীন বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত চাপ কমবে না। তবে এটি কবে শেষ হবে, তা অনিশ্চিত। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে অনুমোদনের পর ৬ বছরে প্রকল্পটির অগ্রগতি মাত্র সাড়ে ১০ শতাংশ। আগামী ৩০ জুন শেষ হবে প্রকল্পের মেয়াদ। রেল সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ বারবার যোগাযোগ করলেও গত ৮ মাসে ঋণের অর্থ ছাড় করেনি ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক।
সক্ষমতার চেয়ে দিনে ১৪টির বেশি ট্রেন চলা দর্শনা-চিলাহাটী রেলপথে কীভাবে ভারতীয় ট্রেন চলবে– প্রশ্নে রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ভারতের ট্রেন জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে পরীক্ষামূলকভাবে চলতে পারে। স্থায়ীভাবে চলাচল শুরু হলে বিদ্যমান ট্রেনগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে সময়সূচি ঠিক করা হবে।
ভারতীয় ট্রেন চলাচলে বাংলাদেশ রেলওয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হবে দাবি করে রেল সচিব বলেছেন, বাংলাদেশের রেলপথ ব্যবহারের জন্য ভারত ট্যারিফ দেবে। এর হার কত হবে তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে ঠিক হবে।
হাসিমারা হয়ে রেলপথ আসামের দিকে গেছে, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছে। দেশটির উত্তর-পূর্বগামী ট্রেন জলপাইগুড়ির ‘চিকেন নেক’ করিডোর ঘুরে যায়। বাংলাদেশের দর্শনা-ঈশ্বরদী-আব্দুলপুর-পার্বতীপুর-চিলাহাটী সেকশন ব্যবহার করে হাসিমারা গেলে ৩০০ কিলোমিটার পথ কমবে।
দূরত্ব কমায় ভারতের যে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে, সে জন্য দেশটির কাছ থেকে ট্যারিফ হিসেবে যৌক্তিক টাকা আদায়ের কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাছুল হক। তিনি বলেন, ভারতীয় ট্রেন চলায় বাংলাদেশের রেলপথের যে অবচয় হবে, তা ধরে ট্যারিফ নির্ধারণ করতে হবে।
এদিকে আসামের কোকড়াঝাড় জেলা থেকে ভুটানের গেলোপো পর্যন্ত ৫৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করছে ভারত। ঢাকার রেল ভবনের প্রস্তাব ছিল, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারত যে ট্রেন চালাতে চায়, এর শেষ গন্তব্য হবে গেলোপো। তবে ভারত হাসিমারা পর্যন্ত ট্রেন নিতে সম্মত হওয়ায় ভুটানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের পথ এখনই খুলছে না বলে জানিয়েছেন রেল কর্মকর্তারা।
১৯৭৭ সালের বাংলাদেশ-নেপালের ট্রানজিট চুক্তি ২০১১ সালে সংশোধন করা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোহনপুর হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ড হয়ে বাংলাদেশি পণ্য নেপালে যায় এ চুক্তি অনুযায়ী। রেল সচিব জানিয়েছেন, নেপালে যেতে আরেকটি পথ পাচ্ছে বাংলাদেশ। এখন দিনাজপুরের বিরল হয়ে পণ্য পরিবহন করা যাবে।
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ, নেপালসহ উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর মধ্যে রেলপথে সংযোগ বাড়াতে নতুন রেললাইন নির্মাণে স্থান নির্বাচনের জরিপ পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার। বাংলাদেশ ও নেপালের সঙ্গে ১৪টি নতুন রেলপথে সংযুক্ত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে ভারত; যার মধ্যে সীমান্তের বিভিন্ন স্থান দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ৮৬১ কিলোমিটার নতুন পথ তৈরি করতে চায় দেশটি।
বাংলাদেশের কাছ থেকে নৌ এবং সড়কপথে পণ্য পরিবহনের ট্রানজিট আগেই পেয়েছে ভারত। চট্টগ্রাম, মোংলা বন্দরে খালাস করা পণ্য আটটি নির্ধারিত সড়ক রুট ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিতে পারে ভারত। কয়েক ধরনের ফি ছাড়াও প্রতি কিলোমিটারের জন্য টনপ্রতি ১ টাকা ৮৫ পয়সা ট্যারিফ দেয় ভারত। তবে নৌ এবং সড়ক ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশে আয় উল্লেখযোগ্য নয়।