স্বাভাবিক জীবনে ফেরা নিয়ে শঙ্কা

জরুরি বিভাগের চিকিৎসককে গুলিবিদ্ধ পা দেখাচ্ছেন রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার বাসিন্দা শয়ন মণ্ডল। গতকাল শনিবার কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সমকাল
রাজবাড়ী, ভোলা, খোকসা (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি ও ভাণ্ডারিয়া (পিরোজপুর) সংবাদদাতা
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৪ | ২৩:৩২
দরিদ্র পরিবারকে সহায়তার জন্য তারা এসেছিলেন রাজধানী ঢাকায়। কাজ করতেন নানা প্রতিষ্ঠানে। স্বল্প আয় থেকেই নিজের খরচ চালিয়ে বাকিটা পাঠাতেন গ্রামের বাড়িতে। সেই আয়ে সংসার চলত। এমনই তিন তরুণ ঢাকার কয়েকটি এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। সাভারে কাজ করতেন শয়ন মণ্ডল। রাজবাড়ীর এই তরুণকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসা নিতে হচ্ছে কুষ্টিয়ার খোকসায়। পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় কাতরাচ্ছেন নির্মাণশ্রমিক নাঈম সিকদার। এখনও খোঁজ মেলেনি ভোলার মো. হাসানের।
ভয় কাটছে না শয়নের
রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার শয়ন মণ্ডল একটি কেমিক্যাল কোম্পানির সরবরাহকারী। কাজ করতেন ঢাকার সাভার এলাকায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অন্যদের সঙ্গেও যোগ দেন তিনি। ২১ বছর বয়সী এই তরুণ চাকরির ফাঁকে ফাঁকে হেমায়েতপুরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে থাকতেন। এরই মধ্যে ২০ জুলাই দুপুর দেড়টার দিকে তারা মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হঠাৎ নির্বিচার গুলিবর্ষণ শুরু করে পুলিশ। শয়নের বাঁ পায়ে লাগে গুলি। সেখানে এখনও ঢুকে আছে ৫০টির মতো লোহার বল।
গতকাল শনিবার শয়ন এসেছিলেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে। চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়েই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে শয়নকে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কথা হয় এই তরুণের সঙ্গে।
শয়ন শুরুতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার তথ্য জানাতে ভয় পাচ্ছিলেন। পরে তিনি ঘটনার বর্ণনা দেন। শয়ন বলেন, মনের টানেই ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন। আহত হতে পারেন বা মারা যেতে পারেন– এমন কোনো ভাবনাই ছিল না। ২০ জুলাই অফিসে কাজ ছিল না। তাই একটু আগেভাগেই সাভারের হেমায়েতপুর এলাকায় ছাত্রদের আন্দোলনে অংশ নেন। মিছিল শুরুর প্রস্তুতি চলার মধ্যেই পুলিশ
গুলি চালাতে শুরু করে। তাঁর সামান্য দূরে ১০-১২ বছর বয়সী এক মাদ্রাসাছাত্রকে গুলিবিদ্ধ হয়ে
মারা যেতে দেখেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই গুলি লাগে তাঁর বাঁ পায়ে। আন্দোলনকারীরা তাঁকে উদ্ধার করে একটি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় রেখে যান।
পরের দিন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি ফেরেন রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার গ্রামের বাড়িতে। ওই উপজেলার কুঠিমালিয়াট গ্রামের মৃত শওকত মণ্ডলের ছেলে শয়ন। বাড়ি ফেরার পর থেকে খোকসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁর পায়ের অধিকাংশ ক্ষত শুকিয়ে গেছে। তবে মাংসপেশিতে ঢুকে আছে প্রায় ৫০টির লোহার বল। যে কারণে ভালো করে হাঁটতেও পারেন না।
শয়ন জানালেন চিকিৎসক তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেছেন। কিন্তু তাঁর পরিবারের কাছে ওষুধ কেনার টাকাও নেই। মায়ের কাছে সামান্য যে ক’টি টাকা ছিল, শনিবার খোকসা আসা-যাওয়ার ভ্যান ভাড়া দিলেই সেই টাকা শেষ হয়ে যাবে।
মা আসমা খাতুন এদিন এসেছিলেন শয়নের সঙ্গে। তাঁর তিন সন্তানের মধ্যে শয়ন সবার ছোট। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসার খরচ চালানোর জন্য শয়নকে সাভারের চাকরিতে পাঠান। তাঁর আয়েই চলত সংসার। ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে সব সঞ্চয় শেষ আসমা খাতুনের। চিকিৎসক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন গুলি বের করা না গেলে পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারবেন না শয়ন। উন্নত চিকিৎসার জন্য ভালো হাসপাতালে নিতে বলেছেন। সেই খরচ কীভাবে চালাবেন– এ নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। পাশাপাশি পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়েও আতঙ্কে আছেন তিনি।
খোকসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক আবির হোসেন সোহাগ বলেন, শয়নের বাঁ পায়ের মাংসপেশিতে অন্তত
৫০টি লোহার বল ঢুকে আছে। এ জন্য ব্যথা যাচ্ছে না। কুষ্টিয়ায় অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা আছে। সেখানে গেলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
হাড়ের কাছাকাছি ছররা গুলি
পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার লক্ষ্মীপুরা মহল্লার তরুণ নাঈম সিকদার (২৩)। দরিদ্র পরিবারকে সাহায্য করতে আট বছর বছর আগে ঢাকায় পাড়ি জমান। পড়াশোনা আর এগোয়নি। নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। থাকতেন যাত্রাবাড়ী এলাকায়। ৫ আগস্ট দুপুরে ওই এলাকায় পুলিশের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যায় তাঁর ডান পা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে জায়গা না হওয়ায় তাৎক্ষণিক নাঈমকে রাজধানীর সুগন্ধা হাসপাতালে ভর্তি করেন সাধারণ ছাত্ররা। দুই ব্যাগ রক্ত দিয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে তোলেন।
১৫০টির মতো ছররা গুলির কণা বের করা হয় নাঈমের শরীর থেকে।
৭ আগস্ট ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় নাঈমকে। তবে অর্থাভাবে স্বজনরা তাঁকে পরদিনই ফিরিয়ে নেন গ্রামের বাড়িতে। বর্তমানে ভাণ্ডারিয়া উপজেলার লক্ষ্মীপুরা মহল্লার বটতলা-সংলগ্ন বাড়িতে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন নাঈম। গতকাল শনিবার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বিছানায় উঠে বসতে পর্যন্ত পারছেন না নাঈম। সেই সঙ্গে তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগছেন।
লক্ষ্মীপুরার মৃত সোবাহান সিকদারের ছেলে নাঈম। তাঁর বড় ভাই ফিরোজ সিকদার জানান, টাকার জন্য ভাইকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। চিকিৎসকরা জানান, শরীরে এখনও অনেক ছররা গুলির গুঁড়ো রয়েছে। সব বের করতে না পারলে ডান পা অকেজো হয়ে যাবে। স্বজনরা সরকারের কাছে দ্রুত নাঈমের সুচিকিৎসার দাবি করেছেন।
গুলিবিদ্ধ হাসান কোথায়?
৫ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন দোকানশ্রমিক মো. হাসান। এরপর থেকে তাঁর খোঁজ পাচ্ছে না পরিবার। গতকাল শনিবার বিকেলে ভোলা প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে হাসানের মা গোলেনূর বেগম ও বাবা মনির হোসেন ছেলেকে জীবিত বা মৃত– যেভাবেই হোক, ফেরত দেওয়ার দাবি করেন।
হাসানের (১৮) বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। আট বছর ধরে ঢাকার কাপ্তানবাজারের একটি বৈদ্যুতিক পণ্যের দোকানে কাজ করতেন। যাত্রাবাড়ীর সুতিখাল বালুরমাঠ এলাকার বাসায় থাকতেন তিনি। স্বজনরা জানান, ৫ আগস্ট দুপুরে দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন হাসান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে গুলিবিদ্ধ এক তরুণকে ছেলে হিসেবে শনাক্ত করেন মা-বাবা।
ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ভ্যানে করে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দু’জনকে হাসপাতাল নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একজন হাসান। পরে তাঁর স্বজনরা ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান পাননি। হাসানকে জীবিত অথবা মৃত– যেভাবেই হোক পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন স্বজনরা।
- বিষয় :
- কোটা আন্দোলন