ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

দীপু মনি গ্রেপ্তার

ভাই ও স্বজনরা ছিলেন দুর্নীতিতে বেপরোয়া

ভাই ও স্বজনরা ছিলেন দুর্নীতিতে বেপরোয়া

দীপু মনি

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৪ | ০১:২৭

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান জানান, সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএস এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁকে নেওয়া হয় রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে। আজ মঙ্গলবার দীপু মনিকে আদালতে হাজির করার কথা। এদিকে, সাবেক ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়কে গতকাল রাতে ধানমন্ডি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এর আগে রোববার দীপু মনিসহ আওয়ামী লীগ সরকারের ২০ জন সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও ২১ জন সাবেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে মোহাম্মদপুরে একজন নিহতের ঘটনায় হত্যা মামলা হয়েছে। সে মামলায় দীপু মনিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুরেও মামলা রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এ নিয়ে সাবেক তিন মন্ত্রী গ্রেপ্তার হলেন। এর আগে ১৩ আগস্ট সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। সেদিন তাঁর সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। গত ১৪ আগস্ট রাতে গ্রেপ্তার হন ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু এবং সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

আওয়ামী লীগ সরকারের চার মেয়াদের তিন মেয়াদেই ভিন্ন তিন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন দীপু মনি। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি ও তাঁর ভাই ডা. জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদ টিপু বিভিন্ন বিতর্কের জন্ম দেন। নিজে স্বজনসহ জড়িয়ে পড়েন দুর্নীতিতে।

সম্প্রতি গণপিটুনিতে নিহত চাঁদপুরে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের অবৈধ বালু উত্তোলনের নেপথ্য মদদদাতা ছিলেন দীপু মনি। এ কারণে খোদ জেলা আওয়ামী লীগ নেতারাই বিভিন্ন সময়ে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন এ দু’জনের দিকে। চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সেলিম খান একসময় ছোটখাটো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি দীপু মনির সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন এবং তখনই মেঘনা থেকে বালু তুলতে শুরু করেন। বছরের পর বছর ধরে অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে সেলিম খানকে বলা হতো ‘বালুখেকো’।
সরকারি নথি অনুযায়ী ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল– এই চার বছরেই দীপু মনির নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুর সদর উপজেলার ২১টি মৌজা থেকে ৬৬৮ কোটি ৩৩ লাখ ঘনফুটের বেশি বালু তুলেছেন সেলিম খান। প্রতি সিএফটি সাদা বালুর পাইকারি দর ২ টাকা। এই হারে শুধু চার বছরে তিনি যে পরিমাণ বালু তুলেছেন, তার মূল্য প্রায় ১ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। বালু ব্যবসা থেকে হাজারো কোটি টাকা আয় করলেও সরকারি কোষাগারে এক পয়সাও দেননি এই বালুখেকো।

২০২২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর চাঁদপুর জেলা প্রশাসন সেলিম খানকে ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ২৬৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে উত্তোলন করা বালুর রয়্যালটি হিসেবে এই টাকা দেওয়া না হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানায় জেলা প্রশাসন।

সরকারি তদন্তে দেখা গেছে, দীপু মনির সমর্থন ছাড়া সেলিম খান তাঁর বালুর ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারতেন না। তিনি সেলিম খানের জন্য অন্তত তিনবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করেছেন।
২০২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবসের অনুষ্ঠানে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বিষয়টি তুলে ধরেন। সরাসরি নাম উল্লেখ না করে তিনি ওই অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, নদী দখলকারীরা রাজনৈতিক মদদপুষ্ট। যারা মেঘনা থেকে অবৈধভাবে বালু তুলছেন, তাদের সঙ্গে চাঁদপুরের এক নারী মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নদী দখলকারী, বালু উত্তোলনকারী ও তাদের সহযোগীদের বিষয়ে কথা বলার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। 
২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দীপু মনি কয়েকটি সরকারি দপ্তরে অন্তত ১৫টি আধাসরকারি লেটার বা ডিও লেটার লিখেছেন, যাতে সেলিম খান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বালুর ব্যবসা চালিয়ে যেতে এবং ব্যবসা আরও বৃদ্ধি করতে পারেন।

চাঁদপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি
২০২১-২২ সালে চাঁদপুরে সরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের আগেই সেখানকার সাড়ে ৬২ একর জমি মৌজা দরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি দাম দেখিয়ে দলিল করে নেয় দীপু মনির ঘনিষ্ঠজন। তিনি তখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। 

অভিযোগ ওঠে, সরকারের কাছ থেকে ৩৫৯ কোটি টাকা বাড়তি নেওয়ার এ কারসাজিতে জড়িত ব্যক্তিরা তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে এলাকায় পরিচিত। এর মধ্যে তাঁর নিকটাত্মীয়ও রয়েছেন। তারা ভূমি অধিগ্রহণে প্রশাসনিক অনুমোদনের আগেই চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে জায়গা ঠিক করে নিজেদের নামে দলিল করিয়ে নেন। পরবর্তী সময়ে সেসব জমিই প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচন করে এবং জেলা প্রশাসনকে অধিগ্রহণের জন্য বলে।

২০২১ সালের নভেম্বরে জেলা প্রশাসনের এ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেয় ২০২০ সালের ৬ এপ্রিল। এর পর মাঠপর্যায়ে জমির অস্বাভাবিক মূল্য দেখে জেলা প্রশাসন ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ১৩ সদস্যের কমিটি করে দেয়। সেই কমিটি নির্ধারিত মৌজার জমি বেচাকেনার দলিল পর্যালোচনা করে ১৩৯টি দলিল পায় ‘অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে’ রেজিস্ট্রি করা। এসব দলিল হয়েছে ২০২০ সালের ১৮ মে থেকে ২০২১ সালের ১৫ মের মধ্যে, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়-সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরুর পর। ওই জমির দাগ নম্বরের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাবিত জমির দাগ নম্বরের মিল রয়েছে। আবার ওই সব দাগের বাইরে একই মৌজায় একই সময়ে সম্পাদিত ৪০টির বেশি জমি কেনাবেচার দলিল পাওয়া গেছে, যার মূল্য সরকারি মৌজা দরের কাছাকাছি। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য যে জায়গাটি ঠিক করা হয়েছে, কেবল ওই সব দাগের জমির দলিলে অস্বাভাবিক দাম দেখানো হয়েছে।

সেখানে একক নামে সর্বোচ্চ জমি নেন দীপু মনির ভাই জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদ। তাঁর নামে দলিল হয় ৫৬৮ শতাংশ (৫.৬৮ একর) জমির। সাবেক মন্ত্রীর মামাতো ভাই ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলামের নামে দলিল হয় ১৬১ শতাংশ জমির। তাঁর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত চাঁদপুর সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আইয়ুব আলীর নামে কেনা হয় ৯৩ শতাংশ এবং মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী (রাজনৈতিক) টুটুল মজুমদারের নামে ৩৭ শতাংশের দলিল হয়।

খাসজমিতে ভাইয়ের টিপু নগর
সরকারি খাসজমি দখল করে নীলকমল ইউনিয়নের বাহেরচরে বিপুল পরিমাণ খাসজমি নিজের কবজায় নিয়ে দীপু মনির ভাই টিপু তৈরি করেন মাছের ঘের, গবাদি পশুর খামার ও সবজি বাগান। কেবল সরকারি জমির ওপরই নিয়ন্ত্রণ নেননি, ওই এলাকার নাম বদলে নিজের নামে রেখেছেন ‘টিপু নগর’।

আরিফ খান জয় গ্রেপ্তার
ডিএমপি সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুর থানার একটি হত্যা মামলায় সাবেক উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গতকাল রাতে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় এ অভিযান চালানো হয়। ২০১৪ সালে নেত্রকোনা-২ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হন জয়। সাবেক পেশাদার এই ফুটবলার ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ছিলেন।

 

আরও পড়ুন

×