দৃশ্যত নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে যাত্রা
জাতীয় নাগরিক কমিটির আত্মপ্রকাশ
গণভোটে নতুন সংবিধান রচনাসহ আট করণীয় নির্ধারণ

রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রোববার জাতীয় নাগরিক কমিটি ঘোষণা অনুষ্ঠানে নেতারা সমকাল
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ব্যুরো ও মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০১:০৭ | আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০১:৩০
ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়ে নতুন বাংলাদেশ গঠন করার লক্ষ্যে সারাদেশে তরুণ-যুবকদের অন্তর্ভুক্ত করতে আত্মপ্রকাশ করল জাতীয় নাগরিক কমিটি। ৫৬ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য মুহাম্মাদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে আহ্বায়ক এবং ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটিতে তরুণ প্রজন্মের নেতৃস্থানীয়দের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
রোববার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। আগামীতে সারাদেশ সফর করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হবে বলে জানানো হয় সভায়। এদিকে একই দিন চট্টগ্রাম ও মুন্সীগঞ্জে শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
জানা গেছে, নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটির নেতৃত্বে সারাদেশে তরুণদের সংগঠিত করা হবে। এতে শিক্ষার্থীদের নেওয়া হবে না। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সংগঠিত করতে আরও উদ্যোগ নেওয়া হবে। দৃশ্যত নাগরিক কমিটির মাধ্যমে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে এগোলেন তারা।
আহ্বায়ক কমিটির নাম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এতে তরুণদের চিন্তাকে প্রভাবিত করতে (ইনফ্লুয়েন্সার) সক্ষম ব্যক্তিরাই স্থান পেয়েছেন। এর মধ্যে আছেন আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন, ইউটিউবার সালমান মুহাম্মদ মুক্তাদির, তরুণ চিন্তক তুহিন খান, মোহাম্মদ মিরাজ মিয়া, সালেহ উদ্দিন সিফাত, আজহার উদ্দিন অনিক, আকরাম হুসেইন, কানেতা ইয়া লাম লাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হল সংসদের সাবেক জিএস মনিরা শারমীন, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ প্রমুখ। এ ছাড়া গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের দুই সদস্যকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নাগরিক কমিটিতে যোগদানে আগ্রহীদের তথ্য সংগ্রহে বুথ স্থাপন করতে দেখা যায়। বুথে থাকা দায়িত্বশীলরা জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগদানে আগ্রহীদের ফরম পূরণের মাধ্যমে ডাটা সংগ্রহ করছিলেন। তথ্য সংগ্রহ ফরমে নাম, মোবাইল নম্বর, ঠিকানা, পেশা, বয়স, আন্দোলনে অংশগ্রহণের বিবরণ, ঠিকানা এবং নাগরিক কমিটিতে কীভাবে অবদান রাখতে আগ্রহী– এগুলো জানতে চাওয়া হয়।
জানতে চাইলে বুথে থাকা মো. অন্তর নামে একজন দায়িত্বশীল বলেন, অনলাইনে গুগল ফরমের মাধ্যমেও যোগদানের আবেদন নেওয়া হচ্ছে। আরেকজন দায়িত্বশীল বলেন, এখানে কোনো শিক্ষার্থীকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকবেন। এখানে পেশাজীবীদের যুক্ত করা হচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্থা শারমিন বলেন, ‘অচিরেই আমরা এলাকাভিত্তিক সফরের মাধ্যমে জেলা কমিটি ও উপজেলা কমিটি গঠন করব।’
আখতার হোসেন বলেন, ‘সারাদেশ থেকে নাগরিক কমিটিতে যোগদান করার আবেদন আসছে। আমরা তরুণ-যুবক সবাইকে সম্পৃক্ত করব। অতিদ্রুত আমরা পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করব। এই কমিটিকে আমরা গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যাব।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন বলেন, গণঅভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন বা আহত হয়েছেন–সবার আকাঙ্ক্ষা ছিল নতুন বাংলাদেশ তৈরি করা। নতুন বাংলাদেশ আমাদের গঠন করতে হবে। তরুণ প্রজন্ম এবং ছাত্রদের মধ্যে যে ঐক্যবদ্ধ শক্তি রয়েছে তা নিয়ে আমরা রাষ্ট্রের পুনর্গঠন করব। সংস্কার পুনর্গঠনের কাজগুলো করব, বিদেশি চক্রান্ত মোকাবিলা করব।
তিনি আরও বলেন, একটি রাষ্ট্র কাঠামোতে রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, ব্যবসায়ী, স্বাস্থ্যসেবী, প্রবাসীসহ অনেকে থাকেন। আমরা রাষ্ট্র গঠনে নেমেছি, শুধু দল গঠনে নামিনি। তরুণরা প্রত্যেক সেক্টরে কাজ করে নতুন বাংলাদেশ উপহার দেবেন।
আট করণীয় নির্ধারণ
নাগরিক কমিটি প্রাথমিক আটটি কাজ নির্ধারণ করেছে। এগুলো হলো– গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে সমুন্নত রাখা; ছাত্র-জনতার হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে কর্মসূচি গ্রহণ; রাষ্ট্রের জরুরি সংস্কার ও পুনর্গঠন করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজে সহযোগিতা ও জবাবদিহির পরিসর তৈরি করা। আলোচনা, মতবিনিময় ও গণমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে সর্বস্তরের জনতাকে সংহত করার লক্ষ্যে কাজ করা; গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা সমুন্নত করে রাখার লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদী কাঠামো ও শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখা; বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক সংলাপের আয়োজন, গণপরিষদ গঠন করে গণভোটের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরির জন্য গণআলোচনার আয়োজন করা।
আহ্বায়ক কমিটিতে গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আহনাফ আবির আশরাফুল্লাহর বোন সৈয়দা আক্তার এবং শহীদ রায়হান হোসেন সাদ্দামের বোন স্বর্ণা আক্তারকে স্থান দেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানের শুরুতে শহীদদের জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়, এর পর মুখপাত্র সামান্তা শারমিন লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন।
দুর্নীতির বিষদাঁত উপড়ে ফেলব: চট্টগ্রামে হাসনাত আবদুল্লাহ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ছাত্র আন্দোলনকে কেউ দলীয়করণ করার চেষ্টা করবেন না। আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতাকে পুঁজি করে আপনারা যদি ভেবে থাকেন আবার দুর্নীতি শুরু করবেন, তবে ছাত্র-নাগরিক আপনাদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলবে।
গতকাল বিকেলে নগরের লালদীঘি ময়দানে গণঅভ্যুত্থানের শরিক ছাত্র-নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ, সহসমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিতে ভরে যায় লালদীঘি মাঠ।
সভায় দুর্নীতিবাজদের হুঁশিয়ারি দিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘ছাত্রদের আন্দোলন ছিল ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ও টেন্ডারবাজদের বিরুদ্ধে। টেন্ডারবাজ-দুর্নীতিবাজদের সতর্ক করতে চাই আমরা। ১৬ বছর একটি দলের ছত্রছায়ায় ছিলেন, এখন যদি আর একটি দলের ছত্রছায়ায় এসে আপনারা দুর্নীতি করার চেষ্টা করেন, তাহলে ছাত্র-জনতা আপনাদের দেখে নেবে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, এই ছাত্র-নাগরিকদের পাওয়ার কিছুই নেই, আমরা ত্যাগ করতে প্রস্তুত। আমাদের ছাত্র-নাগরিক রাস্তায় এসে দাঁড়ায়, পুলিশের সামনে বুক পেতে দেয়। আমরা বুলেট-বোমা ভয় পাই না। তাই দুর্নীতিবাজরা সতর্ক হয়ে যান।’
তিনি আরও বলেন, ‘বীর চট্টলাবাসী সবসময় ধর্মভীরু। কিন্তু আমরা দেখেছি তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সবসময় ধর্মীয় গোঁড়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দাড়ি-টুপিধারীদের প্রান্তিকীকরণ করা হয়েছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার বিভাজনের রাজনীতি বিদ্যমান রেখে ফ্যাসিজম কায়েম করেছে। কিন্তু ফ্যাসিজম-পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা উদাহরণ তৈরি করেছি। মন্দির পাহারা দিয়েছে আমাদের দাড়ি-টুপিওয়ালা ভাইয়েরা। আমাদের সবার প্রথম পরিচয় আমরা বাংলাদেশি।’
পুলিশকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনারা কাজে ফিরে আসুন। আপনাদের মধ্যে যারা খুনিদের দোসর ছিল, তাদের আমরা জানি। সব পুলিশ কিন্তু বেনজীর না। সব পুলিশ ডিবি হারুন না। আমার বাবা, আমার ভাই; তারাও কিন্তু পুলিশ। সুতরাং পুলিশদের আমরা সহযোগিতা করব। দেখেন বেনজীর দেশে থাকতে পারেননি; ডিবি হারুনও ভালো নেই। সুতরাং আপনারা জনমুখী না হয়ে ক্ষমতামুখী হলে আপনাদের অবস্থাও বেনজীর এবং হারুনের মতো হবে।
পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন হাসনাত আবদুল্লাহ ও অন্য কেন্দ্রীয় সমন্বয়করা।
ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়নের ডকুমেন্ট জীবন্ত রাখতে হবে: সারজিস আলম
ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেছেন, যেদিন ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছে এবং ছাত্ররা সামনের সারিতে ছিল, সেদিনই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে। এই ছাত্র-জনতার ওপর বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের যে আস্থা রয়েছে, তা দেশের তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নেই। গতকাল বিকেলে মুন্সীগঞ্জ শহরের সরকারি হরগঙ্গা কলেজ মাঠে ছাত্র-জনতার সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন তিনি।
সারজিস আলম প্রশ্ন রেখে বলেন, বিগত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন ঈদের পরে, পূজার পরে, বিভিন্ন সময়ের পরে বিভিন্ন প্রোগ্রাম দেওয়ার চেষ্টা করেছে এ ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের জন্য; তারা কি পেরেছিল?
সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে ছাত্র-জনতার উদ্দেশে ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে সারজিস বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের ডকুমেন্টসগুলো জীবন্ত রাখতে হবে। তারা চাইবে স্মৃতিগুলো ভুলিয়ে দিতে।
এদিন বিকেলে সারজিস আলমসহ ১৪ সদস্যের দল সরকারি হরগঙ্গা কলেজ মাঠে গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্র-নাগরিক মতবিনিময় সভায় অংশ নেয়। সেখানে ব্যানার-মিছিল নিয়ে সহস্রাধিক মানুষ অংশ নেয়।
দুপুরে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন সমন্বয়করা। এতে জেলা জাতীয় পার্টির একাংশ, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীরা অংশ নেন।