ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

পাহাড়ে খাঁ খাঁ, পর্যটকের ঢল কক্সবাজার-কুয়াকাটায়

পাহাড়ে খাঁ খাঁ, পর্যটকের ঢল কক্সবাজার-কুয়াকাটায়

পর্যটকের ঢল কক্সবাজার-কুয়াকাটায়। ছবি: সমকাল

সাহাদাত হোসেন পরশ, ঢাকা ও ইব্রাহিম খলিল মামুন, কক্সবাজার 

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪ | ০২:৫৫ | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৪ | ০৯:৩০

তিন পার্বত্য জেলার পর্যটনে এ যেন অচেনা দৃশ্য। হোটেলগুলো ফাঁকা; পর্যটকবাহী গাড়ি অলস বসে আছে। পর্যটক ঘিরে পাহাড়ি-বাঙালিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিক্রি নেই বললেই চলে। ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন গুনছেন হাজার হাজার কোটি টাকার লোকসান। কেউ কেউ ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কথাও ভাবছেন। শারদীয় দুর্গাপূজা ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে চার দিনের ছুটি থাকলেও হোটেল-মোটেলে বুকিং নেই। পর্যটক না থাকায় কক্ষগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। বসে বসে সময় কাটাচ্ছেন পর্যটনসংশ্লিষ্টরা। 
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান– এ তিন পার্বত্য জেলায় ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত পর্যটকদের ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছে প্রশাসন। তিন জেলা প্রশাসক এ নির্দেশনা জারি করেন। ৮ অক্টোবর থেকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯ সেপ্টেম্বর এক বাঙালি যুবকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও হামলার প্রতিবাদে ২১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর তিন দিনের অবরোধে খাগড়াছড়ি ও সাজেকে পর্যটকরা আটকে পড়েন। ২৪ সেপ্টেম্বর সাজেকে পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এতে খাগড়াছড়িও প্রায় পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে। তখন থেকে চলছে পর্যটনে খরা। এদিকে শহরের রেস্তোরাঁগুলোয় নেই বেচাবিক্রি। সাজেকে পর্যটনকেন্দ্রের পরিস্থিতি আরও নাজুক। ১৯ সেপ্টেম্বরের পর সেখানেও কোনো পর্যটক নেই। সাজেকে ১১৬টি হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ রয়েছে। ৪০টির বেশি রেস্তোরাঁ থাকলেও কোনো বিক্রি নেই।

সাজেক রিসোর্ট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক রাহুল চাকমা জং সমকালকে বলেন, ‘সাজেকে সব মিলিয়ে প্রতিদিন ৬০-৭০ লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের পথে বসার দশা। নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রশাসন পর্যটকদের আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে আমরা সব দপ্তরে যাচ্ছি।’ 

রাঙামাটির হাউস বোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বাপ্পী তঞ্চংগ্যা বলেন, ৯৯ শতাংশ পর্যটক বুকিং বাতিল করেছেন। প্রশাসন রাঙামাটিতে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, পুরো মৌসুমে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রতিদিন ২০-৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে। তিনি বলেন, রাঙামাটিতে এখন এমন কোনো পরিস্থিতি নেই যে, পর্যটকদের আসতে নিরুৎসাহিত করতে হবে। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার অনুরোধ করেছি। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের পর্যটন খাতের বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৭৬ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। দেশে ৩০টি পর্যটন গন্তব্য রয়েছে। বছরে প্রায় ২ কোটি ৫ লাখ স্থানীয় পর্যটক এসব স্পট পরিদর্শন করেন। অনানুষ্ঠানিক এক হিসাব অনুযায়ী, দেশীয় পর্যটকের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ পার্বত্য জেলাগুলোতে ভ্রমণ করেন। এছাড়া কক্সবাজারসহ তিনটি পার্বত্য জেলা ঘুরতে যান ৫৫ শতাংশ দেশীয় পর্যটক। 

সোমবার বান্দরবান প্রেস ক্লাবের সংবাদ সম্মেলন করে বান্দরবান পর্যটন ব্যবসায়ী সমন্বয় পরিষদ। সংগঠনের আহ্বায়ক নাছিরুল আলম বলেন, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ঝামেলা চলার কারণে সব পর্যটক বান্দরবানে আসা শুরু করেছেন। হোটেল ও পরিবহনে ছাড় দেওয়ার ঘোষণা এবং দুর্গাপূজা ও প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে অগ্রিম বুকিং দেওয়া শুরু হয়। এর মধ্যে প্রশাসনের ‘ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায়’ পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। পর্যটকদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। নির্বাহী আদেশ ছাড়া একটা নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা দিয়ে ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে প্রশাসন।

এদিকে বাঙালি হিন্দুদের বৃহত্তর ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা ঘিরে টানা চার দিনের ছুটিতে কক্সবাজারে পর্যটকের ঢল নামছে। কক্সবাজারে  থাকা পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেলের ৮০ শতাংশ কক্ষ ইতোমধ্যে বুকিং হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের আশা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে বৃহস্পতিবার থেকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে পর্যটকের ঢল নামবে।

মালিকদের তথ্য মতে, সৈকত ঘিরে কক্সবাজারে হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস রয়েছে পাঁচ শতাধিক। এসব হোটেলে দৈনিক প্রায় দেড় লাখ পর্যটকের রাতযাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। এবারের দুর্গাপূজার মধ্য দিয়েই পর্যটন মৌসুমটা চাঙ্গা হচ্ছে। সাগরপারের হোটেল মিডিয়া ইন্টারন্যাশনালের মহাব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন জানান, অক্টোবর হচ্ছে পর্যটন মৌসুম শুরুর মাস। এবার টানা ছুটির সময়টি আমাদের জন্য সুসংবাদ বয়ে আনছে। এরই মধ্যে আমার হোটেলের ১১৫টি কক্ষের মধ্যে ৮০টি শনিবার ও রোববারের জন্য আগাম বুকিং হয়ে গেছে। 

সী-গাল হোটেলের প্রধান নির্বাহী ইমরুল সিদ্দিকী বলেন, কক্সবাজারের প্রথম পাঁচ তারকা হোটেল হিসেবে আমরা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সৈকত ভ্রমণে যেসব সুযোগ-সুবিধা দিই, সেটা অন্যকারও পক্ষে সম্ভব না। কারণ, আমরা সেবাটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। অতিথি ছাড়াও স্থানীয় লোকজনও হোটেলের সুবিধা নিচ্ছেন। সী-গাল হোটেলের ব্যবস্থাপক নূর আলম বলেন, বৃহস্পতিবার থেকে রোববার পর্যন্ত চার দিনের জন্য হোটেলের সব কক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। 

একইভাবে শহরের তারকা হোটেল সায়মান বিচ রিসোর্ট, ওশান প্যারাডাইস, লং বিচ হোটেল, হোটেল সি প্যালেস, হোটেল ওয়েস্টার্নের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার বলেন, টানা ছুটিতে এবার প্রচুর পর্যটক আগমনের আভাস মিলেছে। এরই মধ্যে তারকা হোটেলগুলোর কক্ষ বুকিং হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে সাধারণ হোটেলসহ কটেজগুলোতেও ৭০ শতাংশ বুকিং হয়েছে। সেই সঙ্গে পাহাড়ে বেড়ানোর ঝুঁকি এড়াতেও এবার কক্সবাজারমুখী পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। 

কক্সবাজার ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম কিবরিয়া খান বলেন, সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে লোকজন ছুটে আসছেন কক্সবাজারে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে। তারা টানা চার দিনের ছুটিতে ঘুরে বেড়াবেন টেকনাফ মগ জমিদারকন্যা আর সাহিত্যিক ধীরাজ ভট্টাচার্যের শতবর্ষের ঐতিহাসিক প্রেমের নিদর্শন মাথিন কূপ, নাফ নদের জালিয়ারদিয়া, মিয়ানমার সীমান্তের রাখাইন রাজ্য, রামু বৌদ্ধপল্লি, ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরসহ শহরের বার্মিজ মার্কেটে। যে মার্কেটের বিক্রেতারা হচ্ছেন রাখাইন ও পাহাড়ি তরুণ-তরুণী।

কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, কুয়াকাটার বেশির ভাগ হোটেল-মোটেল বুকিং হয়ে গেছে। বুধবার আবাসিক হোটেল মোটেল-রিসোর্টের পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুয়াকাটার প্রায় ২০০ আবাসিক হোটেল-মোটেলের প্রথম শ্রেণির হোটেল ইতোমধ্যে শুক্র ও শনিবারের জন্য শতভাগ বুকিং হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির হোটেলগুলোতে এখনও ৭০ শতাংশ বুকিং হলেও পুরোপুরি বুকিং হওয়ার আশায় তারা।

কুয়াকাটা হোটেল এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইব্রাহিম ওয়াহিদ জানান, লম্বা ছুটিকে কাজে লাগাতে ইতোমধ্যে কুয়াকাটায় থাকা প্রথম শ্রেণির আবাসিক হোটেলের প্রায় শতভাগ আর ছোট-বড় আবাসিক হোটেলের প্রায় ৭০ শতাংশ হোটেল কক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়েছে। পর্যটকদের বরণে ইতোমধ্যে প্রস্তুত হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ফিসফ্রাই, আচার ঝিনুক, বার্মিজ ব্যবসায়ীসহ মোট ১৬টি পেশার প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক। হোটেল বেস্ট সাউদার্নের পরিচালক সালমান রাব্বি জানান, আমাদের হোটেলে থাকা ৩১টি কক্ষ শুক্রবার-শনিবার শতভাগ এবং বাকি দুই দিন ৭০-৮০ শতাংশ রুম ইতোমধ্যে বুকিং হয়েছে। এখনও অনেক ফোন আসছে কিন্তু আমরা রুম দিতে পারছি না।

হোটেল ডিমোর কুয়াকাটা পরিচালক জয়নুল আবেদিন জুয়েল জানান, প্রতিবছরে কুয়াকাটাতে পর্যটক বাড়ছেন। ট্যুরিস্ট পুলিশ কুয়াকাটা রিজিয়নের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, লম্বা ছুটিকে কাজে লাগিয়ে কুয়াকাটায় বাড়তি চাপ সামলাতে ট্যুরিস্ট পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, থানা পুলিশ নিয়ে সম্মিলিতভাবে নেওয়া হয়েছে বাড়তি প্রস্তুতি।

আরও পড়ুন

×