ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সাত কলেজ নিয়ে হচ্ছে না নতুন বিশ্ববিদ্যালয়

সাত কলেজ নিয়ে হচ্ছে না নতুন বিশ্ববিদ্যালয়

.

 সাব্বির নেওয়াজ

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৪ | ০১:২২ | আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২৪ | ০৮:১৮

২০১৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে রাজধানীর বড় সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হয়েছিল। আট বছর পরে এসে এখন এই সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা বলছেন, সরকারের ওই সিদ্ধান্ত ছিল সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত। ফলে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কলেজগুলোকে অধিভুক্ত করা হয়েছিল, তা আট বছরেও অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বিপরীতে এসব কলেজে শিক্ষার পরিবেশে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। শিক্ষার মানের উন্নতির পরিবর্তে ঢাবি প্রশাসনের বৈষম্যমূলক বিভিন্ন নীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার যথাযথ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই বৈষম্য আর বঞ্চনা থেকেই শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমেছেন। এখন তাদের দাবি, রাজধানীর এই সাতটি কলেজ নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত বা স্বতন্ত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ দাবি পূরণে গত সোমবার সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা। এই ২৪ ঘণ্টা গতকাল মঙ্গলবার শেষ হয়। আজ নতুন কর্মসূচি দেবেন তারা।

তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সমস্যার সমাধানে দ্রুতই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। শিগগির এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে মন্ত্রণালয়ে সভা ডাকা হবে। তাদের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হবে। রাজধানী ঢাকায় মোট ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এ মুহূর্তে নতুন করে আর কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা নেই সরকারের। 

সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ও কাজ নিয়ে তাদের ‘প্রায়োরিটি সেট’ করেছে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সরকারের উচ্চ মহল থেকে বলা হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। এখন আগে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে।

আট বছর আগে যে সাতটি কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল করে ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয়, সেগুলো হলো– ঢাকা কলেজ, ইডেন সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজ। 

শিক্ষার্থীদের দাবি কী

সাত কলেজ নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে গত সোমবার রাজধানীর নীলক্ষেত ও সায়েন্সল্যাব মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি চলে। বিকেলে সায়েন্সল্যাব মোড়ে কর্মসূচি থেকে তিন দফা দাবি জানিয়ে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে সেদিনের মতো কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করা হয়।

শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবি হলো সাত কলেজ নিয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করতে দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কার কমিটি গঠন করতে হবে; সংস্কার কমিটি অনধিক ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সাত কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার রূপরেখা প্রণয়ন করবে এবং সংস্কার কমিটি বর্তমান কাঠামো সচল রাখতে ঢাবি প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে, যাতে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সেশন জটিলতার কোনো ধরনের পরিবেশ তৈরি না হয়।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর আন্দোলনের সমন্বয়ক আবদুর রহমান মঙ্গলবার সমকালকে বলেন, আমরা চরম বৈষম্যের শিকার। দীর্ঘদিনের অধিভুক্তির পরও ঢাবির অধীনে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার মানের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সাত কলেজের অধিভুক্তির বিপক্ষে। 

শুরু থেকেই বৈষম্য ও বঞ্চনা

সাত কলেজের অন্তত ২৫ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। এই শিক্ষার্থীদের বক্তব্যে উঠে এসেছে তারা কীভাবে শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। 

তাদের দাবি স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়হীনতায় ভুগছেন সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা। কলেজগুলোতে বিভাগভিত্তিক গুণগত ভালো শিক্ষকের অপ্রতুলতা রয়েছে। ঢাবির শিক্ষার্থীরা গবেষণার সুযোগ পান, কিন্তু সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা গবেষণার সুযোগ পান না। ঢাবির শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালিত হলেও সাত কলেজের সুনির্দিষ্ট কোনো একাডেমিক ক্যালেন্ডার নেই। শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক সংকট রয়েছে। ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন ৮-৯ জন। কোনো কলেজে বিভাগ চলে ২-৩ জন শিক্ষক দিয়ে। আবার কোনো কলেজে নির্দিষ্ট বিভাগে শিক্ষকই নেই।

এ ছাড়া ক্লাসরুম সংকট তীব্র। অনার্স ও মাস্টার্সের জন্য যে পরিমাণ ক্লাসরুম প্রয়োজন, তা নেই। ফলে শ্রেণি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পরীক্ষার আগে কখনোই সম্পূর্ণ সিলেবাস শেষ করা হয় না। 

একাধিক শিক্ষার্থীর অভিযোগ, তাদের ফল প্রকাশে বিলম্ব করা হয়। বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, ঢাবি ছয় থেকে সাত মাস পর পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে। খাতা মূল্যায়নের সময় তাদের গণহারে ফেল করিয়ে দেওয়া হয়। অথচ ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারিত মানের শিক্ষার্থীরাই এই সাত কলেজে পড়ছেন। তাদের ভাষ্য, ঢাবি কর্তৃপক্ষ সাত কলেজ থেকে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা আয় করছে। কিন্তু সাত কলেজের উন্নয়নে তারা কোনো ব্যয় করে না। তাদের মন্তব্য, সিস্টেমে সাত কলেজকে ঢাবির ‘ব্যবসা কেন্দ্র’ বানানো হয়েছে। 

ঢাকা কলেজের ছাত্র রফিকুল ইসলাম বলেন, সাত কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবগুলোতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। শিক্ষার্থীরা কীভাবে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করবে? আর হুটহাট আমাদের পরীক্ষা শুরু হয়, তখন শিক্ষার্থীরা নিজেদের গুছিয়ে নিতে হিমশিম খায়। 

ইডেন কলেজের ছাত্রী তাসনিয়া তাবাসসুম তন্বী বলেন, আমাদের ক্লাস নেন বিসিএস ক্যাডার শিক্ষক। আর পরীক্ষায় প্রশ্ন করেন ঢাবির পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক, খাতাও দেখেন তারাই। 

যার কারণে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজেদের সেরাটা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। তিনি বলেন, এক বর্ষের পরীক্ষা শুরু হলে সব বর্ষের ক্লাস বন্ধ থাকে। এতে পড়াশোনায় মারাত্মক ক্ষতি হয়। এ ছাড়া সক্ষমতার বাইরে মাত্রাতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। 

যা বলছেন ঢাবি উপাচার্য

শিক্ষার্থীদের বৈষম্যের অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান সমকালকে বলেন, সাত কলেজ নিয়ে আমাদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা থাকলেও সময় এবং সম্পদের যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ কারণে আমি বলব, জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ সাতটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের আরও গভীরতর পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ঢাবির সঙ্গে এসব কলেজের সম্পর্ক উন্নয়নে বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।
শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল বা বহাল একদিকে যেমন জটিল, অন্যদিকে এটা একটা বড় বিষয়। এ নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার আছে। আমরা চাই, সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা যেন কোনো ধরনের ভোগান্তি বা ঝামেলার শিকার না হয়। শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সব ধরনের অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এখানে সরকার, ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যে কোনো ধরনের আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।

অন্যরা কী ভাবছেন

শিক্ষার্থীদের দাবির পক্ষে ইতিবাচক এই সাত কলেজের অধ্যক্ষরাও। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস বলেন, আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের যে দাবি সেটি রাষ্ট্র বিবেচনা করবে। আমরা বর্তমান সময়ে যেসব বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ শিক্ষার্থীরা তুলেছে, সেগুলো নিরসনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. শামছুন নাহার বলেন, আমাদের ছাত্রীদের চাওয়াটাই আমাদের অগ্রাধিকার। 

সাত কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং ঢাবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির পর সম্প্রতি পরীক্ষা ও ফল প্রকাশের সময় এবং পাঠ্যসূচি আগের চেয়ে অনেকটা উন্নতি হলেও বড় তিনটি মৌলিক সমস্যা রয়ে গেছে। এগুলো হচ্ছে– শিক্ষক সংকট, গবেষণাগার ও অবকাঠামোগত সমস্যা এবং প্রথম বর্ষের পর থেকে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিতি কমে যাওয়া।

২০১৯ সালের নভেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে এক সভায় সাত কলেজের অধ্যক্ষরা প্রতিটি বিভাগে অন্তত ১৬ জন করে শিক্ষক নিয়োগের দাবি তুলেছিলেন। যদিও তা বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষকরা বলছেন, এত কম শিক্ষক দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা সম্ভব নয়।

এই সাত কলেজের মূল সংকটের বিষয়ে ঢাকা কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ আই কে সেলিম উল্লাহ খন্দকার বলেন, সাত কলেজের শিক্ষকদের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, একাডেমিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাত কলেজে সাত কর্তৃপক্ষ। এই তিনের সমন্বয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে সংকট সমাধান করতে হবে। এই তিনের সমন্বয় না হলে কোনো দিনই ভালো কিছু হবে না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের বলেন, স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করাই একমাত্র সমাধান নয়। শিক্ষার্থীরা যেসব সমস্যার কথা বলছে, সেগুলো আগে সমাধান করা জরুরি। এ জন্য আমরা দু’দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে মন্ত্রণালয়ে সভা করব। তিনি বলেন, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। নতুন আইন প্রণয়ন, জমি অধিগ্রহণ, প্রকল্প তৈরি ও একনেকে পাস; সব মিলিয়ে ৩-৪ বছরের ব্যাপার। এটা করা হলেও বর্তমান শিক্ষার্থীরা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না। তাই এই শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো সমাধান করা আগে দরকার।

আরও পড়ুন

×