ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

চোখে লেন্স স্থাপনে নৈরাজ্য

চোখে লেন্স স্থাপনে নৈরাজ্য

কোলাজ

তবিবুর রহমান

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৪ | ০৬:৩৮ | আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৪ | ০৯:১১

দৃষ্টিশক্তির সমস্যা নিরসনে চোখে কৃত্রিম স্বচ্ছ লেন্স স্থাপনে রীতিমতো নৈরাজ্য চলছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের দৃশ্যমান তদারকি না থাকায় সংস্থাটির দেওয়া নির্দেশনা মানছে না সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল।

অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চোখের ছানি অপসারণের পর সাধারণত লেন্স স্থাপন করা হয়। কিন্তু অভিযোগ পাওয়া গেছে, অপারেশন প্যাকেজের নামে রোগীদের সঙ্গে কিছু হাসপাতাল ভয়ংকর প্রতারণা করছে। ওটি চার্জ, সিট ভাড়া ও ওষুধের খরচের বাইরেও অনেক হাসপাতাল সার্ভিস চার্জের নামে নিচ্ছে কয়েক গুণ টাকা। এ ছাড়া প্যাকেজের মধ্যে আলাদা করে লেন্সের দাম উল্লেখ করা হয় না। এতে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন রোগীরা।

সম্প্রতি সরেজমিন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, হারুন আই হাসপাতাল, ভিশন আই হাসপাতাল, বাংলাদেশ আই হাসপাতাল, ঢাকা আই কেয়ার হাসপাতাল, লায়ন্স আই ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অপথালমোলজি, গ্রিন আই হাসপাতাল, হিকমাহ চক্ষু হাসপাতালসহ রাজধানীর ১৫টি হাসপাতালের রোগী ও স্বজনের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঔষধ প্রশাসনের নিয়ম অনুযায়ী, প্যাকেজে অপারেশন করা নিষেধ। তাই ঔষধ প্রশাসন কর্মকর্তারা বলছেন, প্যাকেজে অপারেশন ও বাড়তি দামে লেন্স বিক্রির লিখিত অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত ডিসেম্বরে ২৯টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ১২৯ ধরনের লেন্সের দাম নির্ধারণ করে দেয় ঔষধ প্রশাসন। সেই সঙ্গে লেন্সের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত না করে বিক্রি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। দেশের সব হাসপাতালে নতুন মূল্য তালিকা নোটিশ বোর্ডে প্রদর্শনেরও নির্দেশ রয়েছে। তবে রাজধানীর বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতালে এই মূল্য তালিকা দৃশ্যমান পাওয়া যায়নি। 

জানা গেছে, রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালেও প্যাকেজে অপারেশন ছাড়া লেন্স স্থাপন হয় না। এর জন্য হাসপাতালভেদে ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। কিন্তু কোনো রোগীকে দেওয়া বিলের মধ্যে আলাদা করে লেন্সের দাম উল্লেখ থাকছে না। অথচ ঔষধ প্রশাসনের নির্দেশনায় রোগীকে লেন্সের নাম, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য এবং উৎপাদক দেশের নাম উল্লেখ করে ক্যাশমেমো দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া নিয়ম রয়েছে, ফ্যাকো সার্জারির পর রোগীকে লেন্সের প্যাকেট সরবরাহ করতে হবে। লেন্সের প্যাকেটের গায়ে উল্লেখ থাকতে হবে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, উৎপাদক দেশ এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য, যাতে সার্জনরা সেটি দেখে নির্দেশনা দিতে পারেন। কিন্তু কোনো হাসপাতাল এই নির্দেশনা মানছে না।

আই ফাউন্ডেশন হাসপাতালের চিকিৎসক সাজেদুর রহমান ও ডা. জাহিদুল ইসলাম বলেন, দেশের কোনো বেসরকারি হাসপাতালে প্যাকেজ ছাড়া লেন্স স্থাপন করতে পারবেন না। রোগীরা ইচ্ছা করলেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে লেন্স কিনতে পারেন না।

বাংলাদেশ আই হাসপাতালের ব্যবস্থাপক সানজিদ আহমেদ বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে মূল্য তালিকা হাসপাতালে ঝুলিয়ে দেব। এতদিন কেন ছিল না– জানতে চাইলে এড়িয়ে যান তিনি।

ভিশন আই হাসপাতালের এমডি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এ ধরনের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, এটি দেখার দায়িত্ব কি আপনাকে ঔষধ প্রশাসন দিয়েছে? আমরা কোনো নির্দেশনা পাইনি। 

চোখের চিকিৎসার একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ের চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট। এখানে রোগীর বেশি চাপ ও অব্যবস্থাপনার কারণে একটি ছানি অপসারণে অস্ত্রোপচারের তারিখ পেতে সময় লাগে ছয় মাস। ফলে বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে ছানি অপারেশন করাতে যান রোগীরা। অভিযোগ আছে, এ সুযোগ নিয়ে লেন্সের দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে প্যাকেজের মাধ্যমে ছানি অপারেশন করছে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল। 

সম্প্রতি চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ছানি অপারেশন করানো ইয়াসির আরাফাত নামে এক রোগী বলেন, আগে এখানে চিকিৎসকরা ছানি অপারেশন করতেন। তখন সবকিছু ছিল বিনামূল্যে। এখন ফ্যাকো সার্জারির নামে মেশিন দিয়ে এই অস্ত্রোপচার করা হয়। এতে বিনামূল্যে এই সেবা নিতে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।

জানা গেছে, চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বেশির ভাগ চিকিৎসক বিকেলে বেসরকারি হাসপাতালে চেম্বার করেন। দ্রুত অস্ত্রোপচার করা প্রয়োজন– এমন রোগীকে তারা ওই বেসরকারি হাসপাতালে যেতে পরামর্শ দেন। বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর চোখে একটি লেন্স বসলে চিকিৎসকের পকেটে এর দামের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন ঢোকে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অপারেশনের তারিখ পেতে দীর্ঘ সময় প্রসঙ্গে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খাইর আহমেদ চৌধুরী বলেন, দেশে বর্তমানে ছয় লাখের বেশি ছানি রোগী রয়েছেন। 

বছরে দুই লাখ নতুন রোগী বাড়লেও চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৪০০ জন। তাদের অধিকাংশ ঢাকাকেন্দ্রিক। তাই এই হাসপাতালে চাপ বেশি। দ্রুত অস্ত্রোপচারের জন্য রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালে যান। তবে রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালে যেতে চিকিৎসকের পরামর্শের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি তা এড়িয়ে যান।

চোখে লেন্স সরবরাহে নিবন্ধনহীন প্রতিষ্ঠান

মেডিটেক লাইফসায়েন্স নামে এক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘদিন চোখের লেন্স সরবরাহ করে আসছে। তবে গত ডিসেম্বরে অতিরিক্ত দামে লেন্স বিক্রির অভিযোগে তাদের নিবন্ধন সাময়িক স্থগিত করে ঔষধ প্রশাসন। তবে এখনও প্রতিষ্ঠানটি বহাল তবিয়তেই লেন্স ব্যবসা পরিচালনা করছে। গত এক সপ্তাহে ১০টির বেশি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে এ তথ্য মিলেছে। লাইফসায়েন্সের বিপণন কর্মকর্তা হৃদয় আহমেদ লেন্স সরবরাহের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ঔষধ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এই কাজ হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে মেডিটেক লাইফসায়েন্সের এমডি বাশির তালুকদারের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। বিপণন কর্মকর্তা হৃদয় আহমেদ বলেন, স্যার দেশের বাইরে রয়েছেন। এ বিষয়ে স্যার বলতে পারবেন।

বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, যদি কোনো হাসপাতালে অপারেশন প্যাকেজের নামে প্রতারণা করে, তাহলে সরকারের উচিত এদের শক্ত হাতে দমন করা।

এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল কাজী মো. রশীদ উন নবী বলেন, এই খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১২৯ ধরনের লেন্সের দাম বেঁধে দেওয়া হয়। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বেশি দাম নিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া ভুক্তভোগীরা ক্যাশমেমোসহ লিখিত অভিযোগ করলে সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মেডিটেক লাইফসায়েন্স অবৈধভাবে লেন্স সরবরাহ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

আরও পড়ুন

×