ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

শুভ জন্মদিন জাদুকর

শুভ জন্মদিন জাদুকর

হুমায়ূন আহমেদ

 হামিম কামাল

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:৩০

আজ প্রবাদপ্রতিম জনপ্রিয়তার অধিকারী বাঙালি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন।  
হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের ভুবনে এক ধরনের নিহিলবাদ নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর তৈরি চরিত্রগুলো চাওয়া-পাওয়ার দিক থেকে পিছিয়ে, ত্যাগের দিক থেকে এগিয়ে, এক অর্থহীনতায় অর্থপূর্ণ জগতের বাসিন্দা থেকে গেছে শেষতক। এবং তাদের মূল চরিত্র ছিল মানুষের শুভবোধের অনুগামী, মমতাময় এবং বাসনা-দমিত। এমন চারিত্রিক আবহ আগেও অনেক সাহিত্যিক তৈরি করেছেন, কিন্তু তা করতে গিয়ে অনেক ক্লিশেকে আহ্বান করতে হয়েছে তাদের। হুমায়ূন কি ক্লিশে ছিলেন? বহুপ্রজ লেখকদের এই এক শাপ বহন করতেই হয়। তবে তাদের বিপুলা আনন্দদায়ক সৃষ্ট কর্মের সামনে ওইটুকু ক্লিশে বৃহত্তর পাঠক মেনে নেন বলেই তারা বিপুলের ভালোবাসা পান, বিশেষের ঈর্ষা পান। সাধারণ পাঠক একজন দু’জনকে বিভ্রান্ত করা যায়, কিন্তু তাদের সম্মিলিত মননকে ধোঁকা দেওয়া যায় না। বহু ক্লিশেকে তারা পরিত্যাগ করেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন; লেখকের জীবদ্দশাতেই কিংবা জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে। হুমায়ূন কি পরিত্যক্ত হয়েছেন? তাঁর সময়ের উন্নাসিক প্রাজ্ঞরা যে আশঙ্কা করেছিলেন, তা কি সত্য হয়েছে? 

আমার ধারণা, সন্দেহের অবকাশ আছে। তাঁর মৃত্যুর এক যুগ পেরিয়েছে। ধ্রুপদি চেনা যায় মানুষের সাড়ায়। ক্রমাগত নতুন আসছে। নতুন আগমনেও যে পুরাতন ঢাকা পড়ে না, বহুল ব্যবহারেও যার সোনারং মলিন হয় না, তা ধ্রুপদি। প্রতিবছরের একুশে গ্রন্থমেলা বলছে, হুমায়ূন এখনও প্রবল, সবল। এখনও মানুষ তাঁকে খুঁজছে। আমার ধারণা, খুঁজে যাবে। এর একটা কারণ, মানুষকে তিনি মানুষ চেনান। কিন্তু চেনানোর সময় তাঁর শিক্ষকতার গাম্ভীর্য আড়াল থাকে। সঙ্গে নির্ভেজাল গল্প। এমন নিখাদ গল্প খুব কম লেখকই সৃষ্টি করতে পেরেছেন, যে গল্পের টানে পাঠক বাদবাকি সমস্ত দাবি ক্ষমা করেছে। প্রধানত, বিশুদ্ধ দৃঢ় ভাষার দাবি। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দ্বান্দ্বিকতা ব্যাখ্যার দাবি। বাংলাদেশে সুচেতনা ও সৎ সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ আহমদ ছফার আক্ষেপ ছিল হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে। বলতেন, ছেলেটা সমাজদ্বন্দ্বকে স্পর্শ করছে না। জনপ্রিয়তার পথ সে তার মতো করে চিনে গেছে এবং সেই পথে হাঁটছে। তিনি সন্দিহান ছিলেন ভবিষ্যৎ এই ছেলেটিকে কোথায় নিয়ে যাবে তা নিয়ে; যে ছেলের ওপর একদিন তিনি আস্থা রেখেছিলেন, স্বপ্ন দেখেছিলেন। আহমদ ছফার প্রজ্ঞার ওপর শ্রদ্ধা রেখেই, আমার মনে হয়, বিনীত দ্বিমত করা চলে। সমাজদ্বান্দ্বিকতার বহু মাত্রা রয়েছে। সবাই সব মাত্রা স্পর্শ করেন না। এটা প্রকৃতি নির্ধারিত নিয়তিই হয়তো। একেকজন একেক মাত্রা নিয়ে কাজ করেন। যে যা করছেন, তা সৎভাবে করছেন তো? এটাই বিপ্রদাসের শেষ প্রশ্ন। হুমায়ূনের ব্যাপারে এ প্রশ্নের উত্তর কী– এ নিয়ে তর্ক হতে পারে। আর এই তর্কেই উত্তর। কারণ তর্ক তা নিয়েই হয়, যার গাণিতিক মীমাংসা টানা যায় না। যায় না বলেই মানবিক দ্বৈরথ থামে না।  

    একই সময়ে, একই রাজনৈতিকতায় মানবিক মূল্যবোধের প্রতি সমান পক্ষপাতী একেক সাহিত্যিক একেক মাত্রা নিয়ে কাজ করেছেন এ দেশে। এবং আমাদের সৌভাগ্য আমরা সেই সময় একঝাঁক প্রাজ্ঞ পথিকৃৎ পেয়েছি। তাদের কেউ মানুষেরা যে পথে যা শুনতে ভালোবাসে তাকে সে পথে তা শোনাননি। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বিষাদজাগানিয়া, রহস্যমিতা, হাস্যমুখী। কষ্টের কথাও বলতেন এমনভাবে যে, মানুষের বুকের ওপর কখন পাথর চাপিয়ে দেওয়া হলো, তা সে হাসির অবকাশে টের পেল না! জগতের সঙ্গে মানুষের একটা পঞ্চইন্দ্রিয়াতীত যোগাযোগ রয়েছে। হুমায়ূন প্রথম জীবনে এই যোগের সঙ্গে লড়াই করেছেন, দ্বিতীয় জীবনে লড়াইয়ে পরাস্ত হয়ে এই যোগ আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। মৃত্যুর পর মানুষ কখনও প্রকৃতিকে ছেড়ে যায় না, প্রকৃতিও তাকে ছাড়ে না। কোন মায়াজালে তারা বিজড়িত? হুমায়ূন তা ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। মানুষের অবচেতন আয়নায় সেই মায়ার একটা সত্য রূপ ধরা পড়ে। সেই রূপের সঙ্গে হুমায়ূনের দেখানো রূপ মিলেছে আমার বিশ্বাস। তাই মানুষ ভালোবেসে সেই সত্যের ঋণ পরিশোধ করেছে। মানুষ যা শুনতে চেয়েছে, হুমায়ূন তা শোনাননি। মানুষ তো মুক্তমনা ভাবভঙ্গি নিতে সেভাবে প্রস্তুত ছিল না। স্রষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিল না। তবে হ্যাঁ, স্বার্থত্যাগে প্রস্তুত না থাকলেও স্বার্থত্যাগ করছে এমন একটা ছবি মনে ফুটিয়ে তুলতে মানুষের ভালো লাগত। এটুকু বাদে, মানুষ যা চায়, তা যদি হুমায়ূন দিতেন, তাহলে মানুষ তার চাহিদার নিয়মেই তাঁর লেখা পরিত্যাগ করত। তাঁর সময়ের সাধারণ-অসাধারণ সিংহভাগ মানুষ তা করেনি এবং ভবিষ্যতের গড় মানুষেরাও এখন পর্যন্ত করছে না। একটা সংশয়বাদ, একটা অসম্পূর্ণ জ্ঞানবাদ তিনি শেষ পর্যন্ত ব্যক্ত করেছেন। জগতের বিপরীতে মানুষের অসম্পূর্ণতা, অক্ষমতাও তাঁর লেখায় প্রতিষ্ঠিত; এবং সেই জগৎ স্বয়ং অর্থহীন। এর ভেতর তাঁর হাইলাইটটুকু কোথায়। হুমায়ূন আহমেদ মানুষকে ওই অসম্পূর্ণতা নিয়েই সুখী করতে চেয়েছিলেন। এ ধরনের সুখী নিহিলবাদীকে পরলোকে অসুখী দস্তয়েভস্কি হয়তো মৃদু হেসে এড়িয়ে যাবেন, কিন্তু তুর্গেনেভ কাছে টানবেন আমার বিশ্বাস। বলবেন, ‘ছেলে, তোমার পিঠে ছোরা মেরেছে কে জানো?’ হুমায়ূন বলবেন, ‘কে স্যার?’ তুর্গেনেভ বলবেন, ‘তোমার জনপ্রিয়তা।’ 
    ভালোবাসা জনপ্রিয়তার ‍ছুরিবিদ্ধ কথাসাহিত্যের জাদুকর। শুভ জন্মদিন। 

আরও পড়ুন

×