সংস্কার কমিশনে আদিবাসীর কোনো অংশগ্রহণ নেই: রেহমান সোবহান

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান। ফাইল ছবি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৭
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, দেশে সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সংবিধানসহ ১০টি ইস্যুতে সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। তবে এসব কমিশনে আদিবাসীসহ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। বৈষম্য বিলোপে রাষ্ট্রের এ উদ্যোগে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর কথা বিবেচনায় না নিলে আবারও বৈষম্য হয়ে যায় কিনা, সে বিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে। সবার ন্যায্যতা নিশ্চিত করে রাষ্ট্রের সংস্কার করারও তাগিদ দেন তিনি।
গতকাল শনিবার রাজধানীর তোপখানা রোডের সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত বৈষম্যের অবসান হোক স্লোগান সামনে রেখে ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অংশীদারিত্ব উদযাপন এবং প্রকাশনা উৎসব’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন এ অর্থনীতিবিদ।
অনুষ্ঠানটির যৌথ আয়োজক ছিল ব্রাত্যজন রিসোর্স সেন্টার-বিআরসি, সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট-সেড এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার-পিপিআরসি। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন পিপিআরসির নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ এম হাশেমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক জাকির হোসেন রাজু। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্বকারী কয়েকজনও তাদের বঞ্চনা ও দীর্ঘ সংগ্রামের কথা বলেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ যে বৈষম্যের শিকার, তা দূর করার এখন বড় সুযোগ। দেশের প্রান্তিক মানুষের সংখ্যা বেশি নয়। ১৭ কোটি মানুষের দেশে অল্প কিছু মানুষের সমস্যার সমাধান করতে না পারলে ‘সুইসাইড’ করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ।
তিনি আরও বলেন, গত ৬৫ বছর ধরে প্রান্তিক মানুষদের বিরুদ্ধে চলা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা শুনছি। মনে করেছিলাম, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর বুঝি এর অবসান হবে। দেশে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পাবে। আমাদের ফসল ঘরে ওঠেনি। বরং বৈষম্য দিনে দিনে বাড়ছে। চা শ্রমিক, আদিবাসী বা অন্য জাতিসত্তার মানুষরা আজ যে সমস্যার কথা বলছেন, তা আজকের নয়, বহু পুরোনো। এখন রিকশাওয়ালা বা ছাত্ররা বড় সংখ্যায় জড়ো হয়ে তাদের দাবির কথা বলতে পারছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের সংখ্যা বেশি নয়। এভাবে তারা নিজের কথা বলতে পারে না। এটা রাষ্ট্রকে করতে হবে। প্রয়োজনে সরকার কমিশন করতে পারে। সরকার না করলে নাগরিকদেরই কমিশন করা উচিত।
অল্প সংখ্যক মানুষের সমস্যার সমাধান করতে না পারলে দেশ গড়বেন কীভাবে– এমন প্রশ্ন রেখে রেহমান সোবহান প্রস্তাব দেন, জাতীয় ন্যূনতম মাসিক আয় নির্ধারণ করতে হবে, যা সবার জন্য সম্মানজনক হবে। বিগত সরকার কিছু লোকের জন্য আবাসন প্রকল্প নিয়েছিল। এটা নয়, সবার জন্য আবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যবসায় সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে হবে, যেমন– চা শ্রমিকদের মালিকানার অংশীদার করা যেতে পারে।
অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সরকার এখন অনেক বিষয়ে সংস্কার করছে। তবে শুধু সংস্কার নয়, ন্যায্যতা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের সংস্কার করতে হবে। প্রান্তিক বিভিন্ন জনগোষ্ঠী শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিকভাবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে, যার কোনো শেষ নেই। বর্তমান সরকার চাইলে এখনই কিছু সমস্যার সমাধান করতে পারে।
অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, বর্তমান রাষ্ট্র সংস্কার কাজে প্রান্তিক মানুষদের কণ্ঠস্বর পাচ্ছি না। তাদের প্রতিনিধিত্ব করার কেউ নেই। তাদের কথাও কেউ শুনছে না। এই প্রান্তিক মানুষগুলো বলছে, তারা সংস্কারে ভয় পায়। কারণ, যখনই কোনো সংস্কার হয়, তখন তারা আরও বৈষম্যের শিকার হয়। সংস্কার যে কারও জন্য আতঙ্কের হতে পারে, তা জানা ছিল না। সমতলের ৭ লাখ আদিবাসীর সংখ্যা সরকারি হিসাবে কী করে ৪ লাখে নামল, তা প্রশ্নের বিষয়।
অধ্যাপক সৈয়দ এম হাশেমী বলেন, সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার প্রান্তিক মানুষসহ সবার। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এ চাওয়া আশা করি পূরণ হবে। পিছিয়ে পড়া মানুষ সমাজে এক টেবিলে চা খেতে পারবে না, এমন সমাজ ব্যবস্থার অবসান হওয়া উচিত।
ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, দেশের আদিবাসীদের স্বীকৃতি দরকার। এটা আদিতে বাস করার স্বীকৃতি নয়, এটা তাদের সংস্কৃতির স্বীকৃতি। বর্তমান সরকার যেমন ‘গুম’ সনদে স্বাক্ষর করেছে, তেমনি ১৯৮৯ সালের আদিবাসী সনদে স্বাক্ষর করা উচিত। তিনি বলেন, নাগরিকত্বের সঙ্গে ভূমির অধিকার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্থায়ী ঠিকানা না থাকলে কোনো প্রার্থীর সরকারি চাকরি হয় না। অথচ সংবিধানে-আইনে চাকরির সমান অধিকারের কথা বলা আছে। সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবার ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
সেডের নির্বাহী পরিচালক ফিলিপ গাইন অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশে বাংলাভাষী ছাড়া অন্তত ১১০টি বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ আছে। তাদের ৪০টির বেশি ভাষা। এখন যে বৈষম্য বিরোধের কথা বলা হচ্ছে এবং নানা সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে এসব জাতির মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক সুরক্ষার বিষয়ে কথা থাকতে হবে।
- বিষয় :
- সংস্কার কমিশন
- সংখ্যালঘু
- আদিবাসী