ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

প্রসাধনী পণ্য কিনতে আসল-নকলের চক্কর

প্রসাধনী পণ্য কিনতে আসল-নকলের চক্কর

কোলাজ

 জসিম উদ্দিন বাদল

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ০১:০৯ | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ১০:২৬

বয়সের ছাপ দূর করে ত্বক হবে টানটান। কালচে ভাব সরিয়ে বাড়াবে উজ্জ্বলতা। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি, নেই কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। অনলাইনে এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে রাজধানীর ফার্মগেট থেকে একটি কোরিয়ান ‘মিল্ক সুথিং জেল’ কেনেন সায়েরা খানম। ৫৫০ টাকায় জেলটি কেনার পর সপ্তাহখানেক ব্যবহার করেন এই গৃহিণী। কয়েক দিন পরই মুখে ঘামাচির মতো দানা দেখে ঘাবড়ে যান। উপায় না দেখে ছোটেন চিকিৎসকের কাছে। 

আসল খুঁজতে গিয়ে নকলের ফাঁদে পড়া সায়েরা খানম বলেন, ‘মুখ থেকে এই দানা দূর করতে আমি তিনবার ডাক্তার দেখাইছি। ডাক্তার দেখানো ও ওষুধ বাবদ খরচ হয়েছে পাঁচ হাজার টাকার বেশি।’ তাঁর ভাষ্য, আসল আমদানিকারকের স্টিকার, উৎপাদন, মেয়াদ ও দাম– সব যাচাই করে কিনলেও কোরিয়ান ওই জেলটি ছিল নকল। ফলে সেটি ত্বকের উপকারের বদলে মারাত্মক ক্ষতি করেছে।

ঢাকার পলাশী বাজার থেকে কয়েক দিন আগে কোলগেট টুথপেস্ট কেনেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কেনার সময় মনে হয়েছে, পেস্টটি অরিজিনাল। ব্যবহার করার সময় মনে হলো, এটি ভেজাল।’

সায়েরা খানম ও সাইফুল ইসলামের মতো প্রতিনিয়ত এভাবে আসল-নকলের চক্করে পড়ছেন অনেক ক্রেতা। অনলাইন-অফলাইনে মনভোলানো বিজ্ঞাপন দেখে ক্রেতারা কিনছেন এসব নকল পণ্য। এতে একদিকে যেমন ঠকছেন ক্রেতা, অন্যদিকে পড়ছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

ভোক্তারা বলছেন, বর্তমানে হাত বাড়ালেই মিলছে ভেজাল প্রসাধনী। পণ্যের মোড়ক দেখে কারও বোঝার সাধ্য নেই আসল-নকল। দেশি-বিদেশি বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর মোড়ক নকল করে তা বাজারজাত করা হচ্ছে। কখনও কখনও পরিত্যক্ত মোড়ক ও কৌটাতে ভেজাল প্রসাধনী ঢুকিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে আসল পণ্যের দামে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে দিন দিন বাড়ছে প্রসাধনী পণ্যের চাহিদা। বাড়ছে উৎপাদনও। তবে চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতার পকেট কাটার চিন্তা করলেও কখনোই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি পণ্যের মান উন্নয়নে। ফলে বাজার সয়লাব ভেজাল আর নকলে, যা মোট পণ্যের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। এসব পণ্যের ভিড়ে বাজারে এক প্রকার উধাও আসল প্রসাধনসামগ্রী। এতে ভোক্তারা পড়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। এসব পণ্য ব্যবহারে ত্বকে দাগ পড়া, স্কিন ক্যান্সার, মাথার চুল পড়া, চামড়া বিকৃত হওয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন ভোক্তারা।

তবে যুগ যুগ ধরে এভাবে মানহীন পণ্য দেদার বেচাকেনা হলেও নজরদারি রহস্যবৃত্ত। ফলে ক্রেতারা দেশি পণ্যের চেয়ে বিদেশি পণ্যের মান ভালো– এমন বিশ্বাস থেকেই ছোটেন বিদেশি প্রসাধনীর দিকে। অন্যদিকে, ব্যবসায়ীরাও বিদেশি পণ্যের চাহিদার সুযোগ লুফে নিচ্ছেন। অবৈধ উপায়ে আমদানি হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য। তাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে চাহিদা ও সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে উৎপাদনে এগিয়ে আসছেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। তারা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রসাধনী পণ্য উৎপাদন করছেন। ক্রেতারাও এসব পণ্যে ধীরে ধীরে আস্থা পাচ্ছেন। তবে তাদের ভাষ্য, সরকার প্রয়োজনীয় নীতি-সহায়তা দিলে দেশে দ্রুত উৎপাদন বাড়বে, আমদানিনির্ভরতা কমবে। তাতে ভোক্তারাও ভেজাল ও নকল পণ্য কেনার প্রতারণা থেকে মুক্তি পাবেন। অন্যদিকে বাড়বে কর্মসংস্থানের ব্যাপ্তি।

স্বাস্থ্যঝুঁকি
ক্ষতিকর উপাদান থাকায় বড় জরিমানার মুখে পড়তে হয়েছে বিশ্বখ্যাত কোম্পানি জনসন অ্যান্ড জনসনকে। ইভান প্লটকিন নামে এক মার্কিনি বছরের পর বছর জনসন অ্যান্ড জনসনের বেবি পাউডার ব্যবহারের পর অসুস্থ বোধ করলে ২০২১ সালে একটি মামলা করেন। গত ১৬ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে প্রমাণিত হয়, জনসনের ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করায় তিনি মিসেথেলিওমা নামে বিরল এক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। এর পর জনসনকে ১৫ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৮০ কোটি টাকা। এভাবে বিভিন্ন সময় প্যান্টিন, ব্রুট, ইউনিলিভার, ওল্ড স্পাইস ইত্যাদি নামিদামি বিদেশি পণ্যে ক্ষতিকর উপাদান থাকায় বিভিন্ন দেশের বাজার থেকে পণ্যগুলো প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটেছে। তবে বাংলাদেশের বাজার থেকে সেসব পণ্য প্রত্যাহার হয়নি।

এ ব্যাপারে ঢাবির অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, এখন পুরোনো কোম্পানিগুলোর পণ্য কম চলে। তাই মানুষ বিদেশি পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন। তবে দেশটা চোরাচালানে ভরা। কোনটা থাইল্যান্ডের আর কোনটা ভারত কিংবা মালয়েশিয়ার, তা শনাক্ত করা সাধারণ ক্রেতার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তিনি বলেন, বাজারের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ প্রসাধনীতে ভেজাল আছে। প্রসাধনী খাতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। সে জন্য যে যেভাবে পারছে, নকল করে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। এটি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

ভিএলসিসি হেলথ কেয়ারের কসমেটিকস ডার্মাটোলজি বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. শারমিনা হক মনে করেন, নকল ও ভেজাল পণ্য ব্যবহার করে মানুষ নানা গুরুতর রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে বিদেশি পণ্য বর্জন করা। মানসম্পন্ন পণ্য ব্যবহার করা। তবে কিছু দেশি প্রতিষ্ঠান গবেষণা করে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রসাধনী পণ্য উৎপাদন করছে। এগুলো ক্রেতাদের ব্যবহার উপযোগী হতে পারে।

এসব পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই)। তবে বাজারে এসব পণ্যের অধিকাংশেরই মান ঠিক করতে পারেনি সংস্থাটি। বিএসটিআইর উপপরিচালক মোরশেদা বেগম বলেন, পণ্যের মান নিশ্চিত হওয়ার পর যেন তা বাজারজাত করা হয়, সেই চেষ্টা করছি। সামগ্রিক উৎপাদনের ৩০ শতাংশ পণ্য বিএসটিআইর মান সনদের আওতায় এসেছে।

চোরাকারবারির দখলে আমদানির বড় অংশ
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য বলছে, দেশে কালার কসমেটিকস পণ্যের চাহিদা প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার। পাশাপাশি স্কিন কেয়ার পণ্যের চাহিদা রয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার। তবে এর বড় অংশই আমদানি হয় চোরাকারবারির মাধ্যমে। যার পরিমাণ প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার। এর বাইরেও বড় একটা অংশ রয়েছে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের কসমেটিকসের দখলে। এসব পণ্য ব্যবহারে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

বিদেশি ব্র্যান্ডের দর চড়া
দেশের চেয়ে বিদেশি ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর দাম কয়েক গুণ বেশি। দেশি ব্র্যান্ডের একটি ৪০০ গ্রামের লোশন পাওয়া যায় ৪৫০ থেকে ৫১০ টাকায়। আর আমদানি করা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লোশন কিনতে লাগে ৯০০ থেকে হাজার টাকা। দেশি ১০০ মিলিগ্রামের একটি ক্রিম ৮০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হলেও বিদেশি ব্র্যান্ডের কিনতে দাম গুনতে হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। একইভাবে দেশি একটা লিপজেল ৩০ থেকে ৭০ টাকায় কেনা গেলেও বিদেশি লিপজেল কিনতে প্রয়োজন হয় ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। ক্রেতাদের অভিযোগ, বিক্রেতারা এসব পণ্যে ইচ্ছামতো দাম লাগিয়ে বিক্রি করছেন। এতে ঠকছেন ক্রেতারা।

নকল প্রসাধনীর আখড়া পুরান ঢাকা
নকল প্রসাধনী তৈরির আখড়া হিসেবে পরিচিত পুরান ঢাকার কয়েকটি এলাকা। যেখানে রয়েছে তিন শতাধিক কারখানা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এলাকা চকবাজার, লালবাগ, ইসলামবাগ, মৌলভীবাজার, বেগমবাজার, মোগলটুলী, জিনজিরা ও কেরানীগঞ্জ। এ ছাড়া ঢাকার আশুলিয়া ও সাভার এবং উত্তরাঞ্চলের কয়েক জেলাতেও তৈরি হচ্ছে ভেজাল-নকল প্রসাধনী। এসব কারখানা থেকে বিভিন্ন হাত ঘুরে মানহীন পণ্যগুলো বড় সুপারশপ, বিপণিবিতান ও মফস্বলে ছড়িয়ে পড়ছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী জানান, সাবান, পানি, রাসায়নিক আর কিছুটা সুগন্ধির মিশ্রণে শ্যাম্পু তৈরি করা হয়। পুরোনো যন্ত্রপাতির মরিচা তোলা হয় এমন তেলের সঙ্গে সুগন্ধি মিশিয়ে মাথায় ব্যবহারের তেল তৈরি করা হয়। নামি-দামি ব্র্যান্ডের খালি বোতল জোগাড় করা হয় টোকাই আর ভাঙাড়িওয়ালার মাধ্যমে। এরপর সেগুলো বোতলজাত করে বিভিন্ন মার্কেটে সরবরাহ করা হয় অনেক কম দামে। তবে পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক এসব পণ্য উৎপাদনের বিষয়টি অনেকটা খোলামেলা হলেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুল জলিল বলেন, এ বিষয়ে তদারকি কার্যক্রম চলমান। তবে দেশে বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদনের বিকল্প নেই। যেসব প্রতিষ্ঠান গুণগত মান বজায় রেখে পণ্য উৎপাদনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ভোক্তা অধিদপ্তর তাদের পাশে আছে।

নীতি-সহায়তা চান উদ্যোক্তারা
এ খাতের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স বাংলাদেশের (এএসবিএমইবি) সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দীন বলেন, দেশে এসব পণ্যের বাজার বড় হলেও উৎপাদন ও বাজারজাতকারীদের পণ্যের আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করার বিষয়টিকে আমলে নিতে দেখা যায় না। এতে ক্রেতা প্রতারিত হচ্ছেন। তবে দেশে বেশ কিছু কোম্পানি উন্নত ফর্মুলেশন-গবেষণা খাতে বিনিয়োগ করছে। তাতে উন্নত মানের পণ্য উৎপাদন হচ্ছে।

দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারের নীতি-সহায়তা দরকার বলে মনে করেন প্রসাধন পণ্য খাতের এ নেতা। তিনি বলেন, স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী এ শিল্পে বিনিয়োগ হলে ৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। তবে এসব পণ্যের কাঁচামালে শুল্ক-কর বেশি, বিপরীতে সরাসরি কসমেটিকসের আমদানিতে শুল্ক-কর কম। এ কারণে দেশীয় উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন না।

 

আরও পড়ুন

×