সার কেনায় বিলম্বে ক্ষতি ৪০০ কোটি

ছবি-সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:২৩ | আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৪ | ০৬:৩২
সার উৎপাদনকারী বহুজাতিক কোম্পানি কাফকো বাংলাদেশ থেকে সার কেনার ক্ষেত্রে শিল্প মন্ত্রণালয়ের কালক্ষেপণে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন ব্যাহত হয়। পরে চাহিদা মেটাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে বেশি দরে ৬০ হাজার টন সার আমদানিতে সরকারের ক্ষতি হয় ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার, যা বর্তমান মুদ্রাবিনিময় হারে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। এতে বলা হয়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জাকিয়া সুলতানাসহ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে থাকা তৎকালীন কর্মকর্তারা ইচ্ছা করে সংকট তৈরির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ অপচয় করেছেন। এসব কর্মকর্তার বিষয়ে যথাযথ তদন্ত হওয়া দরকার বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
বিসিআইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ডলার সংকটের সময় সরকার আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নেয়। অথচ সে সময় শিল্প সচিব ও মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার ইচ্ছাকৃত কালক্ষেপণে ক্ষতি হয় ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারের বেশি। এর বাইরেও গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে শিল্প মন্ত্রণালয় এবং বিসিআইসিতে দরপত্রসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও সচিব এবং ওইসব কর্মকর্তা রেখে কালো অধ্যায় উন্মোচন সম্ভব নয়।
বিসিআইসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে কাফকো থেকে সার কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ৬ লাখ টন। জুলাই মাসে দুই লটে ৬০ হাজার টন সার উত্তোলনের পরিকল্পনা করে সরকার। এর পর কাফকো থেকে প্রতি টন ৪৩৭ দশমিক ৮৭ ডলার দরে প্রথম লটের ৩০ হাজার টন সার কিনতে ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে ২০২১ সালের ২৩ জুন প্রস্তাব পাঠায় শিল্প মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবের বিপরীতে মন্ত্রণালয় ২৯ জুন বিসিআইসির কাছে কিছু প্রশ্ন রেখে সেগুলোর জবাবসহ জরুরি ভিত্তিতে প্রথম লট ৬ জুলাইয়ের মধ্যে অনুমোদনের অনুরোধ জানায়। এর পর ১৮ জুলাই আবারও কিছু প্রশ্ন রাখলে ১৯ জুলাই জবাব দেয় বিসিআইসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিসিআইসি যথাযথ জবাব দিলেও শিল্প মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদনের জন্য পাঠায়নি। বিষয়টি নিয়ে বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানার সঙ্গে তিন দফায় দেখা করে গুরুত্ব বর্ণনা করলেও লাভ হয়নি। পরে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী ও কৃষি সচিবকে জানানো হয়। এ ছাড়া একই বছরের ২৭ জুলাই দ্বিতীয় লটে ৩০ হাজার টন সার ক্রয় প্রস্তাব শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
প্রথম লটের অনুমোদন না পাওয়ায় কাফকো থেকে সার উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। এতে ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা ও খুলনা অঞ্চলে মিনি পিক সিজনে ইউরিয়ার সংকট দেখা দেয়। পরে বিসিআইসি জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় বিপর্যয় এড়াতে ১ আগস্ট ‘বিশেষ বোর্ড সভা’ করে। সভায় দক্ষিণাঞ্চলে জোগান অব্যাহত রাখা ও অন্যান্য লটের সার সংগ্রহের সুযোগ সৃষ্টিতে প্রথম লট সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়। এর পর ২ আগস্ট কাফকো থেকে প্রথম লটের সার উত্তোলন শুরু করে সংশ্লিষ্ট জেলায় দ্রুত পাঠায়। দীর্ঘ ৬৭ দিন পর ২৯ আগস্ট শিল্প মন্ত্রণালয় প্রথম লট অনুমোদন দেয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে কাফকো বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৬০ হাজার টন সার উত্তোলনের পরিকল্পনা ছিল। বিভিন্ন কারণে কাফকোর সম্ভাব্য ডাউনটাইম ৪০ দিন থাকায় প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার টন উৎপাদন হবে এবং এ পরিমাণ সার ডেলিভারি নেওয়া হবে বিবেচনায় অবশিষ্ট ৩২৫ দিনে কাফকো থেকে মোট সাড়ে ৬ লাখ টন সার কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক মাসের জন্য ইউরিয়া উত্তোলন পূর্বনির্ধারিত থাকায় এক মাসের সার সংগ্রহ কার্যক্রম কোনো কারণে ব্যর্থ হলে পরবর্তী মাসে উত্তোলনের সুযোগ ছিল না। তাই জুলাই ও আগস্টে উত্তোলনের ঘাটতি থাকা ৬০ হাজার টন সার উক্ত অর্থবছরে কাফকো থেকে আর সংগ্রহ করা হয়নি। কাফকোর চেয়ারম্যান ও সিইও হিসেবে শিল্প সচিব বিষয়টি জানতেন। ফলে এ ঘাটতি পূরণে অন্য উৎস থেকে সার সংগ্রহ জরুরি হয়ে পড়ে। এ জন্য বিসিআইসি জিটুজি চুক্তির আওতায় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সৌদি আরবের সাবিক থেকে ৬০ হাজার টন আমদানি করে ইউরিয়ার সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখে। এতে জাহাজ ভাড়াবাবদ সরকারকে গুনতে হয় ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ডলার বা ৩০ কোটি ৮২ লাখ ৩১ হাজার ১০০ টাকা। তাছাড়া কাফকো থেকে প্রতি টন ৪৩৭ দশমিক ৮৭ ডলারে কেনার কথা থাকলেও, সাবিককে দিতে হয় ৯২৯ দশমিক ১৬। মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হয় ২ কোটি ৯৪ লাখ ৭৭ হাজার ৪০০ ডলার বা ২৫৩ কোটি ৬৫ লাখ ৩০ হাজার ২৭০ টাকা।
এ ছাড়া ২০২১ সালের জুলাই মাসে সরকার সার না কেনায় কাফকোর বাল্ক গুদামে স্থান না থাকায় প্রতিষ্ঠানটির সার উৎপাদন ২২ দিন বন্ধ ছিল, যার উৎপাদন ক্ষতি ৪৪ হাজার টন। তৎকালীন মূল্য হিসেবে মোট উৎপাদন ক্ষতি হয় ১ কোটি ৯২ লাখ ৬৬ হাজার ৫০০ ডলার বা ১৬৫ কোটি ৭৮ লাখ ৮২ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে এ ক্ষেত্রে লাভ হতো ৩৯ কোটি ৭৮ লাখ ৯১ হাজার ৭৫৮ টাকা।
কাফকো বাংলাদেশ বহুজাতিক যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। এর চেয়ারম্যান ও সিইও শিল্প সচিব হওয়া সত্ত্বেও কী কারণে জুলাই মাসের দুটি লটে সিসিজিপির অনুমোদন নিতে তিনি উদ্যোগী হননি, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একই কারণে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বিসিআইসির চারটি ইউরিয়া সার কারখানায় ওভারহোলিং/শর্ট শাটডাউন হয়। দীর্ঘদিন কারখানাগুলো ওভারহোলিং না করায় যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। মেরামত শেষে উৎপাদন শুরু হলেও, বন্ধ থাকে দুটি। অন্যদিকে যমুনা সার কারখানায় গ্যাসের চাপ অস্বাভাবিক মাত্রায় কমে যাওয়া এবং কিছু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মোট আটবার শাটডাউনে যেতে হয়। এতে অনেক চেষ্টার পরও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সার উৎপাদন করা যায়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১-২২ অর্থবছরের ঘাটতি মিটিয়ে পরবর্তী বছরের শুরুতে প্রয়োজনীয় মজুত রাখতে কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বাড়তি ৩ লাখ ৮৪ হাজার টন ইউরিয়া আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। তবে এ সার আমদানির অনুমোদন দেয়নি শিল্প মন্ত্রণালয়। এর পর চেয়ারম্যান, বিসিআইসি চেয়ারম্যান সরাসরি শিল্প সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে উল্লিখিত পরিমাণ সার সংগ্রহে দ্রুত অনুমোদন কার্যক্রমের অনুরোধ জানান। কিন্তু সচিব বলেন, সারের কোনো সংকট হবে না, আমদানির প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রস্তাবিত সার সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া না হলে বিসিআইসির পক্ষে কৃষি মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী ইউরিয়া কোনোভাবেই সরবরাহ করা সম্ভব হবে না বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী বিষয়টি অবগত হয়ে সচিবের সঙ্গে আলাপ করে তাদের নির্দেশনা মতে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে ২০২২ সালের ৮ মার্চ মাত্র দেড় লাখ টন সার সংগ্রহের অনুমোদন দেয়। দীর্ঘ বিলম্বের কারণে কাতার অপশনাল প্রভিশনের আওতায় ৯০ হাজার টন সার দিতে সম্মত হলেও, ইউএই অপারগতা জানায়। এ ছাড়া টিএসপি সার উৎপাদনে অন্যতম প্রধান কাঁচামাল ১০ হাজার টন ফসফরিক এসিড আমদানির অনুমতিতে বিলম্ব হওয়ায় বাড়তি দামের কারণে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ২৪ কোটি ৮৫ লাখ ৭২ হাজার ১৯৫ টাকা।
বিসিআইসি বলছে, প্রশ্নের সংখ্যা ও ধরন দেখলে বোঝা যায়– মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিরাপদ মজুতে দায়িত্বশীল না হওয়ায় সরকারের সার সংগ্রহ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। বিষয়টি নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকেও অবহিত করা হয়। এসব কারণে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ তৎকালীন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিষয়ে তদন্ত হওয়া জরুরি।
এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জাকিয়া সুলতানাকে ফোন করা হলে তিনি সরাসরি কথা বলতে চান। তবে দপ্তরে গেলে ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে তিনি মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।
- বিষয় :
- ক্ষতিপূরণ
- সার
- শিল্প মন্ত্রণালয়
- আমদানি
- ক্ষতি সরকারের
- টাকা
- ডলার