কোটা সংস্কার আন্দোলন
সারাদেশে ব্যাপক সংঘর্ষ গুলি নিহত ৩১

কোটা সংস্কার দাবিতে বৃহস্পতিবারও সারাদেশ ছিল অগ্নিগর্ভ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রায়েরবাগ এলাকায় মুখোমুখি পুলিশ ও আন্দোলনকারীরা। ছবি -সাজ্জাদ নয়ন
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৪ | ০১:২৫
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংসতায় সাংবাদিকসহ অন্তত ৩১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ২৪ জন, চট্টগ্রামে ও নরসিংদীতে দু’জন করে এবং রংপুর, সাভার ও মাদারীপুরে একজন করে নিহত রয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ১১ জন ছাত্র। আহত হয়েছেন কয়েকশ মানুষ। এ আন্দোলনে এ পর্যন্ত ৩৭ জন প্রাণ হারালেন।
গতকাল বিক্ষোভ চলাকালে রাজধানীর রামপুরায় বিটিভি ভবন এবং মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও সেতু ভবনে অগ্নিসংযোগ করেন আন্দোলনকারীরা। এতে বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।
এ ছাড়া মিরপুর, মহাখালী, বাড্ডাসহ আরও কয়েকটি এলাকায় পুলিশ বক্সে আগুন ও ভাঙচুর চালানো হয়। আগুন দেওয়া হয় উত্তরা-পূর্ব থানায়ও। গতকাল দুপুর ১২টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঢাকার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন দেশের অধিকাংশ এলাকার রেল যোগাযোগ। রাত ৯টার পর থেকে ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সরকারদলীয় সংগঠনের নেতাকর্মীর সঙ্গে কোটা সংস্কার দাবিতে গতকাল আন্দোলনকারীদের দফায়
দফায় সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে রূপ নেয় বিভিন্ন এলাকা। সেখানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বিভিন্ন বয়সের লোকজনকে দেখা গেছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস গতকাল ছিল সুনসান।
কর্মসূচি চলাকালে রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান আন্দোলনকারীরা। কোথাও ছাত্রলীগ-যুবলীগ জড়ালে সংঘাত ত্রিমুখী রূপ নেয়। যাত্রাবাড়ী ও কাজলায় বুধবার বিকেল থেকে গতকাল রাত ২টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন
আন্দোলনকারীরা। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় আগুন দেওয়া হয়। রাতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় রাজধানীর আরও অনেক এলাকার সড়ক বন্ধ ছিল। পুলিশ, র্যাব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছিলেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ীর কাজলায় ইত্তেফাক পত্রিকা বহনকারী একটি গাড়িতে আগুন দেয় আন্দোলনের নামে সড়কে জড়ো হওয়া ব্যক্তিরা।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে খুনের দায়ে জড়িতদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে গতকাল সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা আসে আন্দোলনকারীদের পক্ষে। আন্দোলনকারীরা গতকাল সকাল থেকে কর্মসূচি পালন করতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ শুরু করেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি সরকার। শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলোচনার জন্য আমাকে ও শিক্ষামন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।’
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিলের শুনানির জন্য রোববার দিন ঠিক করেছেন চেম্বার আদালত। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে ওই দিন এ বিষয়ে শুনানি হবে।
তবে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় যাবে না বলে জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গতকাল সন্ধ্যায় লিখিত বক্তব্যে অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সহিংসতা চালিয়ে সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এর দায় সরকারেরই। শহীদের রক্তের ওপর কোনো সংলাপ হবে না। সরকারকেই সমাধানের পথ বের করতে হবে। শাটডাউন কর্মসূচি আজ শুক্রবার বহাল থাকবে। জুমার নামাজের পর গায়েবানা জানাজা পড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. মো. রিফাত বলেন, গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ১৭৩ জনকে আমাদের হাসপাতালে আনা হয়। তাদের মধ্যে ৩৩ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানা গেছে, বুধবার থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সহিংসতায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় ২৫টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতেই ১৫টি। ছয়টি বাস, দুটি মাইক্রোবাস, ২০টি মোটরসাইকেল, রাজনৈতিক দলের দুটি কার্যালয়, টোল প্লাজা, থানা, পুলিশ বক্স, একটি পুলিশের গাড়ি ও দুটি সরকারি অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গতকাল দুপুরের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। কয়েকশ বিক্ষোভকারী গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও আটকে রাখে। আন্দোলনকারীদের দেওয়া আগুনের কারণে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।
উত্তরায় দিনভর সংঘর্ষ
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে উত্তরায় সড়ক আটকে বিক্ষোভ করতে থাকেন। ঢাকার অন্যতম এই প্রবেশপথে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করলে শুরু হয় সংঘর্ষ। পুলিশের পাশাপাশি র্যাবও অবস্থান করে সেখানে। আন্দোলনকারীরা র্যাব-পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড বোমা ও রাবার বুলেট ছোড়ে। দিনভর থেমে থেমে সংঘাত চলে। এতে ১১ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে ৪ জন, আধুনিক হাসপাতালে ৬ জন ও ক্রিসেন্ট হাসপাতালে একজনের লাশ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের ওপর গাড়ি তুলে দেওয়ার অভিযোগে র্যাবের এক চালককে আন্দোলনকারীরা বেধড়ক পেটান। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
দুপুরে আন্দোলনকারীরা উত্তরা-পূর্ব থানায় আগুন লাগিয়ে দেন। ফায়ার সার্ভিস খবর পেলেও আন্দোলনকারীদের বাধার মুখে অগ্নিনির্বাপণ করতে যেতে পারেনি। উত্তরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সিনিয়র কর্মকর্তা আলম হোসেন বলেন, আমরা জমজম টাওয়ারের সামনে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের বাধার মুখে পড়ি। দেড় ঘণ্টা আটকা থাকার পর সেখান থেকে ফিরে আসি। পরবর্তী সময়ে আমাদের একজন কর্মীকে পাঠিয়েছিলাম অগ্নিকাণ্ডের সর্বশেষ খবর জানতে। কিন্তু পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের চলমান সংঘর্ষের কারণে ওই কর্মী থানায় যেতে না পেরে ফিরে আসেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উত্তরার আব্দুল্লাহপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়ক দিনভর দখলে ছিল শিক্ষার্থীদের। দফায় দফায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। রাত ১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ঢাকার রামপুরা আবুল হোটেলের সামনে এলাকা, মোহাম্মদপুরসহ ৪-৫টি এলাকায় রাস্তায় অবস্থান করছিলেন আন্দোলনকারীরা। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, রাস্তা যারা অবরোধ করে সরকারি স্থাপনায় আগুন ও ভাংচুর করেছে তারা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী নয়। তারা বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী। আইন কেউ হাতে তুলে নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দিনভর উত্তাল প্রগতি সরণি
দিনভর রাজধানীর প্রগতি সরণি অবরোধ করে রাখেন নর্থ সাউথ, ব্র্যাক, ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিসহ আশপাশ এলাকার শিক্ষার্থীরা। প্রথমে বেলা ১১টার পরপরই শিক্ষার্থীরা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ চড়াও হয়। কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি ভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় পুলিশ। এর পর আশপাশ এলাকা থেকে সেখানে আরও অনেকে জড়ো হলে পুলিশ সদস্য অনেকে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি ভবনে আটকা পড়েন। এর পর দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় শিক্ষার্থীদের। পরে বিজিবি সদস্যরা সেখানে হাজির হলে শিক্ষার্থীরা তাদের ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেন। এর পর ব্র্যাক ও ইস্ট-ওয়েস্টের সামনের সড়ক দীর্ঘ সময় শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পৌনে ৩টার দিকে র্যাবের হেলিকপ্টার কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি ভবনের ছাদে আটকা পড়া ৬০ পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে।
বিকেল ৩টার দিকে শিক্ষার্থীরা জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে রাখা একটি মরদেহ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে নিয়ে আসেন। এ সময় আন্দোলনকারীরা স্লোগান দেন। পরে জানা যায়, লাশটি আফতাবনগরের ইম্পেরিয়াল কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র জিল্লুর রহমানের। এ ছাড়া গতকাল যমুনা ফিউচার পার্কের সামনেও অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। হাতিরঝিল এলাকাতেও জড়ো হন অনেকে। সেখানে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও ছররা গুলি ছোড়ে।
সাতমসজিদ রোড রণক্ষেত্র
ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়ক থেকে শুরু করে আবাহনী মাঠ পর্যন্ত সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী ফারহান নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দেন আরও শিক্ষার্থী। তারা সাতমসজিদ রোডে জড়ো হন। এর পর তাদের সঙ্গে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীর সংঘর্ষ বাধে। উভয় পক্ষের হাতে ছিল লাঠিসোটাসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র। দেখা গেছে, পুরো সাতমসজিদ রোডসহ এর আশপাশের পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে। ছাত্রলীগ কর্মী সন্দেহে দু’জনকে আটক করেন আন্দোলনকারীরা। তাদের একজনের কাছ থেকে চাপাতি জব্দ করা হয়। পরে তাঁকে গণপিটুনি দিয়ে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা।
এর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়ক অবরোধ করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এর পর শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ শুরু করে। সে সময় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মী লাঠিসোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেন। পরে পুলিশ ও যুবলীগের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। সংঘর্ষে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজ নিহত হয়।
মিরপুরে পুলিশ বক্সে আগুন
গতকাল সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে অবস্থান নেন। সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দুপুর ২টার দিকে গোলচত্বরের পুলিশ বক্সে আগুন দেন বিক্ষোভকারীরা। শিক্ষার্থীদের দিকে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ। তখন শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। পরে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মী যোগ দেন। শিক্ষার্থীরা আবার সংগঠিত হয়ে ফায়ার সার্ভিসের দিক থেকে মিছিল নিয়ে গোলচত্বর দখলে নেন। দিনভর থেমে থেমে সংঘাত চলতে থাকে। সংঘাতে পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন।
সংঘাত চলার সময় মিরপুর ১০ নম্বরের আশপাশের ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর ১টার দিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী পুলিশের সঙ্গে যোগ দিয়ে গোলচত্বর দখলে নেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা কাজীপাড়ার দিকে আসতে আল-হেলাল হাসপাতালের সামনে অবস্থান নেন। আন্দোলনকারীদের আরেকটি অংশ অবস্থান নেয় মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামের দিকে। মাঝেমাধ্যে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে পুলিশ।
আন্দোলনকারীরাও ইট ছুড়তে থাকেন। বিকেল ৩টার দিকে আন্দোলনকারীরা পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে ধাওয়া করে গোলচত্বর দখলে নেন। বিকেল ৩টার দিকে বিক্ষোভকারীরা অবস্থান করলেও তখন ওই এলাকায় পুলিশ দেখা যায়নি। মিরপুর থানার সামনে পুলিশ অবস্থান নেয়। এরপর শতশত লোক থানা ঘেরাও করেন। তিনটি গাড়িতে তারা আগুন দেন। বিক্ষোভকারী অনেকের হাতে ছিল চায়নিজ কুড়াল, চাপাতিসহ নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আরামবাগে শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করেন। এতে নটর ডেমসহ আশপাশের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীর সঙ্গে তারা সংঘর্ষে জড়ান। পুলিশও কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় আন্দোলনকারীদের। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। বিকেল ৩টার দিকে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। এক পর্যায়ে পুলিশের পিকআপে আগুন ধরিয়ে দেন আন্দোলনকারীরা। অফিসার্স ক্লাব মোড়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং সিদ্ধেশ্বরী কলেজের ছাত্রীরা অবস্থান নেন।
মহাখালীও উত্তাল
তেজগাঁও থানা থেকে শুরু করে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড, রেলগেট ও জাহাঙ্গীর গেট এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষে জড়িয়েছেন পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতাকর্মী। গতকাল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলতে থাকে। শিক্ষার্থীরা জাহাঙ্গীর গেট ও মহাখালী রেলগেট থেকে সৈনিক ক্লাব পর্যন্ত অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় পুলিশ বক্স এবং রেললাইনের ওপরে আগুন দেওয়া হয়।
গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মহাখালী ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে আগুন ধরিয়ে চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দেন শিক্ষার্থীরা। এর পর আমতলী ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের পাল্টা ধাওয়া দিয়ে তিতুমীর কলেজের রাস্তায় নিয়ে যান। পরে সেখানে একটি ক্লাবে আগুন ধরিয়ে দেন তারা। ৬টার দিকে আবারও শিক্ষার্থীরা ফ্লাইওভারের মুখে আগুন ধরিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেন।
মহাখালী এলাকার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক দফা সংঘষের্র পর পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীকে ধাওয়া দিলে তারা পিছু হটেন। দুপুরের পর থেকেই পুরো মহাখালী এলাকা শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এ সময় পুলিশ তেজগাঁও থানার সামনে অবস্থান নেয়।
বিকেলে ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ রুটে চলাচলকারী ব্রহ্মপুত্র ট্রেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ট্রেনটি স্টেশনে আসে। তার পর থেকে মহাখালী রেললাইন অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। বিমানবন্দর ও গাজীপুর স্টেশনেও বিভিন্ন ট্রেন ঢাকায় ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে।
অচল ইসিবি চত্বর
সকাল ১০টার দিকে ইসিবি চত্বরে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় একেবারে অচল হয়ে পড়ে বৃহত্তর মিরপুর ও পল্লবী এলাকা। কর্মসূচি পালনের শুরুতে পুলিশ ও ছাত্রলীগ তাদের ধাওয়া দেয়। পরে শিক্ষার্থীদের পাল্টা ধাওয়ায় এলাকা ছাড়েন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। দুপুরের পর থেকে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন শিক্ষার্থীরা। অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি প্রয়োজনীয় গাড়ি ছাড়া কাউকে যেতে দেওয়া হয়নি। বিকেল ৫টার দিকে ইসিবি চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তা বন্ধ করে স্লোগান দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
সায়েন্সল্যাবেও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া
সায়েন্সল্যাব মোড়ে দেখা যায়, নীলক্ষেতের পাশে লাঠিসোটাসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী। তারা পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। এর আগে রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাসের শেল ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। পরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন গলির মধ্যে ধাওয়া দিয়ে নিয়ে যায়।
এ সময় শিক্ষার্থীরাও তাদের ওপর চড়াও হন। সংঘষের্র সময় সায়েন্সল্যাব মোড়ে ফুট ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করার জন্য বেশ কয়েকজন পথচারীকে মারধর করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। সকাল থেকে সায়েন্সল্যাবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে অংশ নেওয়া পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, দফায় দফায় শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে পুলিশের কয়েকজন আহত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এখানে যারা আন্দোলনে নেমেছে তাদের মধ্যে স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী বেশি।
ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালালে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ
গতকাল রাতে পুলিশ সদরদপ্তর এক বিবৃতিতে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। বিবৃতিতে বলা হয়, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়াসহ জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠছে। আন্দোলনের নামে কোমলমতি নিরীহ ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে একশ্রেণির দুর্বৃত্ত সরকারি স্থাপনা, সম্পদ এমনকি থানায় আক্রমণ করে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটাচ্ছে– যা কাম্য হতে পারে না। ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখলে পুলিশ আইনের কঠোর ও সর্বোচ্চ প্রয়োগে বাধ্য হবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সবাইকে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায় পুলিশ।
নিহত কয়েকজনের পরিচয়
নিহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। গতকাল রাত ১১টার দিকে যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ৫ জনের মরদেহ ঢামেকে আনা হয়। সব মিলিয়ে ঢাকা মেডিকেলে মরদেহ থাকা ১২ জনের মধ্যে নয় জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন– ঢাকা টাইমসের নিজস্ব প্রতিবেদক মেহেদী হাসান, শাকিল হোসেন (২২), নাজমুল কাজী (৩০), ইমরান (২৪), আব্দুল্লাহ (১৫), সায়মন (২৫), ইসমাইল (৩৫), খালিদ সাইফুল্লাহ (১৮) ও ওয়াসিম শেখ (৩৫)। কাজলায় নিহত এক রিকশাচালক ও আজিমপুর থেকে আনা অজ্ঞাতসহ আরও তিনজনের লাশ ঢামেকে আছেন। এ ছাড়া সংঘর্ষের ঘটনায় রাজধানীর উত্তরায় ১১ জন নিহত হয়েছেন।
এদিকে দুলাল মাতবর নামের এক মাইক্রোবাসচালক মেরুল বাড্ডায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সাভারে ইয়ামিন নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হন। নরসিংদীতে তাহমিদ ভূঁইয়া সামিন নামে এমকেএন হাইস্কুল অ্যান্ড হোমের শিক্ষার্থীও নিহতদের তালিকায় আছেন।
এদিকে রংপুর মহানগরীর তাজহাট থানার পাশে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের গুলিতে অটোচালক মানিক মিয়া (৪০) মারা গেছেন। সন্ধ্যার দিকে বেরোবি শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ সারাদেশে মৃত্যুর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা মহাসড়কে অবস্থান করলে পুলিশ তাদের ওপর টিয়ার গ্যাসের শেল, রাবার বুলেটসহ গুলি চালায়।
এ সময় অটোচালক মানিক মিয়া পাশের গ্যারেজে গাড়ি রেখে যাওয়ার পথে পুলিশের গুলিতে পড়ে যান। পরে তাঁকে রংপুর মেডিকেল কলেজে নেওয়ার আগেই তিনি মারা যান। পুলিশের ছোড়া গুলিতে মোকছেদ আলী নামে আরেকজন আহত হয়েছেন। নিহত মানিক মিয়া রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকার পূর্ব ঘাঘট পাড়ার সেকেন্দার আলীর ছেলে। মানিক মিয়ার দাদা আব্দুস সাত্তার মৃত্যুর ঘটনাটি নিশ্চিত করেছেন। রংপুর মহানগরীর তাজহাট থানার পাশে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অটোচালক মানিক মিয়া।
- বিষয় :
- কোটা সংস্কার আন্দোলন
- শাটডাউন