অনিয়ন্ত্রিত আইনশৃঙ্খলা নিরাপত্তাহীন জনগণ

.
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৫৪ | আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৮:৫০
অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এ কারণে জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এমন বক্তব্য উঠে এসেছে গতকাল শনিবার সিরডাপ মিলনায়তনে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) এক আলোচনা সভায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের অগ্রাধিকার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজন ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ : আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গ’ শীর্ষক আলোচনায় পুলিশ সংস্কার নিয়ে বেশ কিছু সুপারিশ উঠে এসেছে। বক্তারা জানান, ব্রিটিশ আমল থেকে পুলিশকে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করছে সরকার। দেশ স্বাধীন আর ক্ষমতার পালাবদলেও এই পরিস্থিতি থেকে আমরা বের হতে পারিনি। পুলিশের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে। বাহিনীটিকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বিশেষায়িত বিভিন্ন ইউনিট গঠন না করে কাঠামো ঠিক করা জরুরি। রাজনৈতিক নেতাদের অন্যায় আবদারে ‘না’ বলার সাহস রাখতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বাহিনীটির সংস্কার ফলপ্রসূ হবে না।
সংলাপের শুরুতে সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো সুশাসনের অভাব। সংস্কার শব্দটি অনেক ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু এটি ঘৃণিত শব্দে পরিণত হয়েছে। সংস্কার চলমান একটি প্রক্রিয়া। আমরা সাধারণ মানুষের কথা শোনার চেষ্টা করছি। অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সাধারণ জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারছেন না, পুলিশ মনোবল হারিয়ে ফেলেছে এবং প্রতিনিয়ত মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, কীভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঠিক করা যায়, তার ওপর নজর দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যা করা হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ছাড়া পুলিশ সংস্কার সম্ভব না। বাহিনীটিকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে ঘাটতি আছে। বর্তমান প্রযুক্তিগুলো তাদের শেখাতে হবে। জনগণেরও পুলিশকে সাহায্য করতে হবে। বাহিনীর কাজের তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। জাতীয় সংসদের মাধ্যমে পুলিশের আচরণবিধি তৈরি করতে হবে। পর্যালোচনা প্রক্রিয়া আনতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল তৈরি করতে হবে।
অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলোকে সাহায্য করতে হবে, যেন ওয়াচ ডগ হিসেবে কাজ করতে পারে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, বিগত সরকার এমন আভাস দিয়েছে, তারা ক্ষমতায় না থাকলে অনেক মানুষ মারা যাবে। পুলিশের সেবা নাকি নিয়ন্ত্রণ দরকার? এখানে কাজ করতে হবে। বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কার করতে হবে, যেন ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ না হয়। পুলিশের কাজ সেবা করা, এটি সব রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এম এনামুল হক বলেন, রাজনৈতিক নেতার আদেশের বিরুদ্ধে ‘না’ বলার সাহস থাকতে হবে, যদি তা আপনার বিবেকে বাধে। কমিশন আগেও হয়েছে, কিন্তু এর প্রয়োগ হয়নি। প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, পুলিশকে আমরা হেনস্তাকারী সংস্থা হিসেবে তৈরি করেছি। সদস্যদের পদোন্নতি ওপর দিকে দেওয়া হয়েছে। ট্রাইবালিজম (গোষ্ঠীতন্ত্র) থেকে বের হতে হবে। বিচার সব জায়গায় থাকতে হবে, কেবল পুলিশের ক্ষেত্রে নয়। ক্ষমা সবার চাইতে হবে। যারা নির্দেশ দিয়েছে, অর্থনীতি ধ্বংস করেছে, তাদেরও ক্ষমা চাইতে হবে এবং বিচারের আওতায় আনতে হবে। ইতিবাচক কর্তৃত্ব থাকতে হবে। অতিরিক্ত জোর প্রয়োগ যেন কেউ আর না করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য মো. জারিফ রহমান বলেন, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে পুলিশ ও জনগণের মাঝে একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। ভুল স্বীকার করেছে পুলিশ। কিন্তু দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ করতে হবে কমিউনিটি পর্যায় থেকে। এখান থেকে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স শুরু করলে অন্য কেউ জুলাই-আগস্টের মতো কিছু করতে চাইলেও পারবে না। কমিশনে এমন মানুষ থাকতে হবে, যারা চাপিয়ে দেওয়া নির্দেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে।
হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ বলেন, ৫২ থেকে এই পর্যন্ত পুলিশের তুলনা করে দেখেন, উন্নতি হয়েছে নাকি অবনতি? পুলিশকে এই পর্যায়ে কে নিয়ে গেল? এগুলো রাজনৈতিক দলগুলো করে থাকে। পুলিশকে অমানবিক কাজে নিয়োজিত করা যাবে না। র্যাবকে বিলুপ্ত করতে হবে। এগুলো না করলে এটা চলতে থাকবে।
সাবেক সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার বলেন, আমরা বলি, দেশের মালিক জনগণ। কিন্তু আসলেই কি তাই? যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তারা কার স্বার্থে কাজ করে? পুলিশ নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয় দেখা যাবে না। যারা ক্যাডার হয়, তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সামগ্রিকভাবে মূল্যবোধ ঠিক করতে হবে। সেনাবাহিনী থেকে র্যাবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। গায়েবি মামলা নিয়ে বর্তমান সরকার কিছু করেনি। পুলিশের বেতন-ভাতা বাড়ানো নিয়ে চিন্তা করতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে পুলিশের ক্ষমতা জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, গত ৫৪ বছরে আমরা রাষ্ট্র গঠন করতে পারিনি। গত চার মাসে কিছু কমিশন হয়েছে, কিন্তু সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা উপজাতি প্রতিনিধি নেই। বৈষম্য- ভেদাভেদ দূর করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বাধীনভাবে কি কাজ করতে পারে? বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে। পুলিশ ও বিচার বিভাগকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা না হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সভাপতি ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, আমাদের দেশে একজন ভালো রাজনীতিবিদ দরকার। ভালো মানুষদের সংসদে আসতে হবে, দেশ শাসনে আসতে হবে। খারাপ ভোটার খারাপ মানুষকে ক্ষমতায় আনবে।
অধিকারের পরিচালক এ এস এম নাসিরুদ্দিন এলান বলেন, পুলিশ গত ১৫ বছর অনেক নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। তারা দায়মুক্ত ছিল, যা বিগত সরকার দিয়েছে। জুলাই-আগস্টের পর তাদের মনোবল কমে গেছে। আমরা যেই সংস্কারের দিকে যেতে চাচ্ছি, সেদিকে যেতে পারছি না।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, পুলিশকে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। এটি প্রতিরোধ করার জন্য মানবাধিকার সনদ মানতে হবে এবং আমাদের যা নিয়ম আছে তা অনুসরণ করতে হবে। বাহিনীর কাঠামো ঠিক করতে হবে। রাজনীতির সংস্কার করতে হবে।
এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠাতারা রাষ্ট্র কি তা বুঝতে পারেননি। রাজনৈতিক দলগুলো আর্টিকেল-৭-এর মধ্যে আটকে আছে। এই রাষ্ট্রে জমিদারি অবস্থা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এখনও চলছে। এখান থেকে বের হতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের গবেষণা ফেলো সাফকাত মুনির বলেন, পুলিশে এত বিশেষায়িত ইউনিট লাগবে না। এতে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। বাহিনীর কাঠামোর দিকে নজর দিতে হবে। তাদের ন্যায্য দাবি দেখতে হবে।
সাবেক জজ ইকতেদার আহমেদ বলেন, পুলিশের সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। অতীত এবং বর্তমান সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করে কাজ করছে। এ রকম হতে থাকলে দেশে কখনও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারবে না।
সিজিএসের চেয়ারম্যান মুনিরা খান বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত সবাই পুলিশকে ব্যবহার করেছে। অন্যায়কারীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগের সঙ্গে পুলিশের সমন্বয় করতে হবে।
- বিষয় :
- জনগণের ক্ষমতায়ন