ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

গোলটেবিলে বক্তারা

মানবিক করিডোর নিয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি হতে পারে

মানবিক করিডোর নিয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি হতে পারে

ছবি: সংগৃহীত

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫ | ২৩:০১

মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক করিডোর জাতিসংঘের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় একটি নতুন অবস্থান স্থাপনে ব্যবহার করতে পারে। আর এটি হলে ভারত ও চীন উভয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক চরম অবনতি হতে পারে। আরাকান আর্মিকে মানবিক করিডোরের সুবিধা দিলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। এতে করে নেপিদোর সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের অবনতি, অস্থিরতা, সংঘাত ও এমনকি যুদ্ধ পর্যন্ত হতে পারে। মানবিক করিডোর নিয়ে এক গোলটেবিলে বক্তারা এসব কথা বলেন।

শনিবার বিকেলে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তা ও মানবিক করিডোর’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্নেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যানালাইসিস (সিজিএসএ)। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং মূখ্য আলোচক হিসেবে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না উপস্থিত ছিলেন। গোলটেবিলে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিজিএসএ নির্বাহী পরিচালক কর্নেল (অব.) জগলুল আহসান।

গোলটেবিলে বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শিক্ষক, সাবেক রাষ্ট্রদূত, সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। গোলটেবিলটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস।

মূল প্রবন্ধে কর্নেল (অব.) জগলুল আহসান বলেন, মানবিক করিডোর নিয়ে সরকারের তিন ব্যাক্তি তিন রকম বক্তব্য দিয়েছেন। এটি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হবে। এটি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের নানান ভূরাজনৈতিক কূটকৌশলে ব্যবহার হতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য বড় নিরাপত্তা হুমকি হবে।

ভূরাজনৈতিক প্রভাব তুলে ধরে তিনি বলেন, ভারত মহাসাগর ঘিরে এক প্রকার বলয় তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারতের মতো বৈশ্বিক ও আঞ্চিলক শক্তিগুলোর আধিপত্য ও ক্ষমতা বিস্তারের বলয় হচ্ছে এ মহাসাগর। প্রকৃতপক্ষে বড় দেশগুলোর এ ভূকৌশলগত আধিপত্যের লড়াইয়ে ছোট দেশগুলো বৃত্তবন্দী। রাখাইনে মানবিক করিপডোর দেওয়ার আগে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কয়েকটি বিষয় আগে নিশ্চিত হওয়া উচিত। এ করিডোর কি বাংলাদেশের ভূকৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে, নাকি ক্ষতি করবে। বাংলাদেশ কোনো দেশ বা জোটের ভূরাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়নের গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না। আর এ করিডোর দিয়ে কোনো বৃহৎ শক্তি জোট বা দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের শত্রু হচ্ছি কি না।

গোলটেবিলে মানবিক করিডরের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের লুকোচুরি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। আমীর খসরু বলেন, করিডর নিয়ে এই সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই। দুই সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি অথবা নিরাপত্তা কাউন্সিলে পাস না হলে এ বিষয়ে জাতিসংঘের ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই।

করিডর নিয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার নয় অভিযোগ করে তিনি বলেন, করিডর নিয়ে সরকারের অবস্থান এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। তারা কী চায় বোঝা যায় না। প্রথমে অস্বীকার করলেও সরকার পরবর্তী সময়ে করিডর নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে। কাতারেও আলোচনা করছে। এত গোপনীয়তার কী আছে?

নির্বাচন থেকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার জন্যই করিডর ইস্যু সামনে আনা হতে পারে অভিযোগ করে আমীর খসরু বলেন, জনগণের সরকারের দিকে না গিয়ে, রোডম্যাপ ঘোষণা না করে আর সবকিছু করছে সরকার।

করিডোরের বিষয়টি সরকারের পরিষ্কার করা দরকার জানিয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এ নিয়ে আলোচনা দরকার। করিডর যদি দেয়া হয় তাহলে এটা নিয়ন্ত্রণ করবে কে আমি মনে করি বাংলাদেশ এটা পারবে না। আমাদের কত বড় একটা নিরাপত্তার ব্যাঘাত হবে! সরকারের এ রকম গোপন এজেন্ডা সম্পর্কে জনগণের সতর্ক হতে হবে। এ রকম সিদ্ধান্ত আসতে হবে সংসদ থেকে, দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাতীয় নির্বাচন দেওয়া। অনেক পার্টি বলেছে, ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। আমাকে যদি বলে তাহলে বলব ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, করিডর দেয়ার সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকারের এজেন্ডার বাইরে। করিডোরকে সামনে এনে সরকার কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে। নির্বাচিত সরকার করিডোর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যতখানি এগিয়েছেন, এখন এমন তৎপরতা বন্ধ করুন। এটি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। অনেক জায়গাতেই মানবিক করিডর সামরিক করিডরে পর্যবসিত হয়েছে। 

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, করিডোর দিয়ে আমাদের স্বার্থ রক্ষা হবে না কি, মানবতা রক্ষা হবে– এটা ভেবে দেখতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে রয়েছে, তাদের বিষয়ে কাউকে মানবিক হতে দেখিনি। করিডোর দেওয়া সরকারের ম্যানডেটের মধ্যে নেই। নির্বাচন থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে নিয়ে যেতে এটি সামনে আনা হয়েছে। এ সময় করিডোর নিয়ন্ত্রণ ও সরকারের এ সংক্রন্ত সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

বাংলাদেশ ভূরাজনীতির ফাঁদে জানিয়ে সিনিয়র সাংবাদিক এম এ আজিজ বলেন, করিডোরের নামে ছলচাতুরি করা হচ্ছে শুরু থেকেই। মিয়ানমারে বন্দর রয়েছে, চীন ও ভারতের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে, সে দিক দিয়ে সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি সামনে আসছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের ১৭ জন সদস্য বিদেশি নাগরিক। মূলত বিদেশি স্বার্থ রাখতে করিডোরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। করিডোরের সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকার নেওয়া উচিত বলে জানান তিনি।

গাজায় মানবিক করিডোরের নামে হত্যাযজ্ঞের চিত্র সামনে আসায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক সংসদ সদস্য নিলোফার চৌধুরী মনি। তিনি বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু মানবিক করিডোর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, এখানে জাতিসংঘ ও বিশ্বের পরাশক্তি গুলোর একটা স্বার্থ আছে। কিন্তু আমাদের স্বার্থটা কি। আমাদের স্বার্থ হচ্ছে এই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো। আমরা আর একটা রোহিঙ্গা কেউ গ্রহণ করতে চাই না। গোপনে নয়, এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

আর গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ঘোষণার পরও নতুন করে প্রবেশ করেছে। করিডোর নিয়ে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা ভালো না। এমন সিদ্ধান্তে এই সরকারের যাওয়া দরকার ছিল না। এই সরকারের মূল কাজ ছিল নির্বাচন দেওয়া। বিচার এবং সংস্কারের দোহায় দিয়ে নির্বাচন বিলম্বের সুযোগ নেই। বিএনপি একা নয়, অনেক দলই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্য সচিব হুমায়রা নূর বলেন, করিডোর দেওয়ার বিষয়ে অনেক চিন্তা করা দরকার। তবে আমরা এটার সমর্থন করি না।

আলোচনায় বক্তারা বলেন, মানবিক করিডোর স্থাপনের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। এ বিষয়ে দেশের সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানান তারা।

আরও পড়ুন

×