নিবন্ধন ফিরে পাচ্ছে জামায়াত
দাঁড়িপাল্লা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন

.
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৫ | ০১:১৭ | আপডেট: ০২ জুন ২০২৫ | ১১:৪৮
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। পাশাপাশি দলটির নিবন্ধন ফেরতের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ গতকাল রোববার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল মঞ্জুর করে এ রায় দেন। ফলে এক যুগ পর রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত নিবন্ধন ফেরত পেতে যাচ্ছে। এর ভিত্তিতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনেও দলটি সক্রিয় হতে যাচ্ছে। তবে এই রায়ে দলটির প্রতীক দাঁড়িপাল্লা বহালের নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, জামায়াতের ক্ষেত্রে পেন্ডিং রেজিস্ট্রেশন (অনিষ্পণ্ন নিবন্ধন) এবং অন্য কোনো ইস্যু যদি থাকে, তা সাংবিধানিক ম্যান্ডেট (ক্ষমতা) পুরোপুরি প্রয়োগ করে নিষ্পত্তি করতে ইসিকে নির্দেশ দেওয়া হলো। এ সময় দলটির আইনজীবীরা দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বহাল বিষয়ে আদেশ চাইলে আপিল বিভাগ বলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি।
জামায়াতের নিবন্ধন-সংক্রান্ত আপিল মামলাটি গতকাল সকালে আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় রায় ঘোষণার জন্য ১ নম্বরে ধার্য ছিল। গত ১৪ মে আপিলের শুনানি শেষে রায়ের এ দিন ধার্য করা হয়। আদালতে জামায়াতের পক্ষে শুনানিতে অংশগ্রহণকারী আইনজীবী এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিক, মোহাম্মদ শিশির মনির এবং কেন্দ্রীয় নেতাসহ কর্মী ও সমর্থকরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রেস ব্রিফিং
রায় ঘোষণার পর জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, নিবন্ধন বাতিলের বিষয়ে হাইকোর্টের যে রায় ছিল, আপিল বিভাগ তা বাতিল ঘোষণা করেছেন। ইসিকে নির্দেশ দিয়েছেন, জামায়াতের রেজিস্ট্রেশন এবং অন্য যেসব বিষয় সামনে আছে বা আসবে, সেগুলো যেন দ্রুত নিষ্পত্তি করে। এর মাধ্যমে নিবন্ধন ফিরে পেল দল। প্রতীকসহ অন্যসব বিষয় নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো হয়েছে।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল শিশির মনির আরও বলেন, আমরা মামলার সংক্ষিপ্ত আদেশ চেয়েছি। আশা করছি সোমবারের মধ্যে তা হাতে পাব। এটা নির্বাচন কমিশনের কাছে উপস্থাপন করব। কমিশন দ্রুত জামায়াতের নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরিয়ে দেবে– এটাই প্রত্যাশা।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, জামায়াতকে ২০০৮ সালে নিবন্ধন দিয়েছিল ইসি। ২০১৩ সালে হাইকোর্ট সে নিবন্ধন বাতিল করে যে রায় দিয়েছিলেন, আপিল বিভাগ তা বাতিল করে দিয়েছেন। ফলে হাইকোর্টের রায়ের আগে যে অবস্থাটা ছিল, সেই অবস্থাটা ফেরত এসেছে। জামায়াতের নিবন্ধন বহাল।
তিনি আরও বলেন, দলটির নিবন্ধন ২০১৩ সাল পর্যন্ত বৈধ ছিল। তখন পর্যন্ত ইসি জামায়াতের কনস্টিটিউশন (ধারাবাহিকতা) বিষয়ে পর্যালোচনা করছিল, ওই পর্যালোচনা পর্যায়ে ওটা স্থগিত হয়ে গিয়েছিল হাইকোর্টে। এখন ইসিকে নির্দেশনা দিয়েছে আপিল বিভাগ ওই পর্যায় থেকে শুরু করার জন্য।
প্রতীকের বিষয়ে ইসির এই আইনজীবী বলেন, এ মামলার ইস্যু প্রতীক ছিল না। প্রতীকের বিষয়ে আদালত কোনো নির্দেশনা দেননি। ওটা ২০১৬ সালে অন্য একটা মাধ্যমে হয়েছিল। তাই অন্যভাবে এটার সমাধান করতে হবে।
প্রতীক নিয়ে কী হবে?
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে জামায়াত নিবন্ধন ফেরত পেলেও দাঁড়িপাল্লা পাবে কিনা, সে বিষয়ে আইনি জটিলতা রয়েছে। কারণ এই প্রতীক কোনো রায় অনুযায়ী বাতিল হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংশোধিত আইনের আলোকে তা বাতিল করা হয়েছিল।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের অংশগ্রহণে ২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ফুল কোর্ট সভা হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায়বিচারের প্রতীক। এটি একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে ব্যবহৃত হবে। অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক সংগঠন বা কোনো নির্বাচনে প্রার্থীর প্রতীক হিসেবে দেওয়া যাবে না। যদি দেওয়া হয়, তাহলে বরাদ্দ বাতিল করার অনুরোধ জানিয়ে ইসি সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সবার বরাবর চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ অনুসারে কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীকে দাঁড়িপাল্লা বরাদ্দ না দিতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ইসিকে চিঠি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। ওই চিঠি ইস্যু হওয়ার পর নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা থেকে প্রতীকটি বাতিল করার প্রস্তাব কমিশন সভায় অনুমোদিত হয়। পরে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে নির্বাচনী প্রতীকের তালিকা থেকে দাঁড়িপাল্লা বাদ দিয়ে ২০১৭ সালের ৮ মার্চ গেজেট জারি করে ইসি।
হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর ইসি ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে। তাতে এ প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার নিয়ে ফুলকোর্ট সভার সিদ্ধান্ত বাতিলের বিষয়ে জামায়াত গত ১২ মে আপিল বিভাগেও আবেদন করেছিল। দলটির করা আপিল ও লিভ টু আপিলের (গতকাল যে আপিলের রায় হয়েছে) সঙ্গে ওই আবেদনটিও শুনানির জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ বিষয়ে গতকাল আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, কোনো পর্যবেক্ষণ ছাড়াই প্রত্যাহার আবেদন মঞ্জুর করা হলো।
নিবন্ধন বাতিলের প্রেক্ষাপট
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনে ইসি। তখন ৩৮টি দলের সঙ্গে জামায়াতও নিবন্ধিত হয়। আইন অনুযায়ী শুধু নিবন্ধিত দলগুলোকেই নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর জামায়াতকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন তরীকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ ব্যক্তি।
রিটে জামায়াতের রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিলের বিষয়ে চারটি কারণ উল্লেখ করা হয়। প্রথমত, নীতিগতভাবে জনগণকে সব ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে না দলটি। পাশাপাশি আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকেও স্বীকার করে না। দ্বিতীয়ত, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে কোনো সাম্প্রদায়িক দল নিবন্ধন পেতে পারে না। অথচ কাজেকর্মে ও বিশ্বাসে এটি সাম্প্রদায়িক দল। তৃতীয়ত, নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কোনো বৈষম্য করতে পারবে না। কিন্তু এর শীর্ষপদে কখনও কোনো নারী বা অমুসলিম যেতে পারবে না। চতুর্থত, কোনো দলের বিদেশে কোনো শাখা থাকতে পারবে না। অথচ জামায়াত বিদেশের একটি সংগঠনের শাখা। তারা স্বীকারই করে– জন্ম ভারতে, বিশ্বজুড়ে শাখা রয়েছে।
ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না– তা জানতে চাওয়া হয়। ওই রুলের শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ। রায়ে সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণ দেখিয়ে দলটির নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। ওই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি। অন্যদিকে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর এর বিরুদ্ধে আপিল করে দলটি। পাশাপাশি লিভ টু আপিল (আপিল অনুমতি চেয়ে আবেদন) খারিজের বিরুদ্ধেও আবেদন করা হয়। ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দলটির করা আপিল ও লিভ টু আপিল খারিজ করে আদেশ দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। আপিলকারীর পক্ষে সেদিন কোনো আইনজীবী না থাকায় আপিল বিভাগ ওই আদেশ (ডিসমিসড ফর ডিফল্ট) দেন।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে আপিল পুনরুজ্জীবিত
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছরের ১০ আগস্ট ‘বিক্ষোভের মুখে’ তৎকালীন প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি পদত্যাগে বাধ্য হন। পুনর্গঠন করা হয় আপিল বিভাগ। এর পর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের আপিল ও লিভ টু আপিল খারিজ করে আপিল বিভাগের দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আবেদন দায়েরের ক্ষেত্রে ২৮৬ দিন বিলম্ব মার্জনার আবেদন করে দলটি। গত ২২ অক্টোবর আপিল বিভাগ জামায়াতের আবেদন মঞ্জুর (রিস্টোর) করে আদেশ দেন। ফলে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের করা আপিল ও লিভ টু আপিল পুনরায় শুনানির পথ উন্মুক্ত হয়। এর ধারাবাহিকতায় ৫ কার্যদিবস শুনানি শেষে গতকাল জামায়াতের নিবন্ধন বহালের রায় দেন আপিল বিভাগ।
- বিষয় :
- জামায়াতে ইসলামী
- রাজনৈতিক দল