ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

১৪১ আরটি-পিসিআর ল্যাব সচল করতে এবার নতুন প্রকল্প

১৪১ আরটি-পিসিআর ল্যাব সচল করতে এবার নতুন প্রকল্প

.

তবিবুর রহমান

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫ | ০১:৪৯ | আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৫ | ১৪:০৩

নির্দেশনার প্রায় দুই মাস পর সারাদেশের সরকারি হাসপাতালে করোনা শনাক্তের ২১টি আরটি-পিসিআর ল্যাব সচল হয়েছে। এখনও ১৪১টি আরটি-পিসিআর ল্যাব অচল। পরিকল্পনায় গলদ, অব্যবস্থাপনা, জনবল ও কিট সংকটে এসব ল্যাব ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ল্যাবগুলো চালু করতে এখন নতুন প্রকল্প নেওয়ার কথা ভাবছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। 

এসব ল্যাবে করোনাসহ ২৫ ধরনের ভাইরাস শনাক্ত করার সুযোগ আছে। কিন্তু করোনা মহামারি শেষ হওয়ার পর এগুলো যথাযথভাবে ব্যবহার করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তখন কোনো পরিকল্পনা জানানো হয়নি মাঠ পর্যায়ে। ফলে আনুমানিক ২১১ কোটি টাকার মূল্যবান যন্ত্র অব্যহৃত থেকে নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।

সারাদেশে সমকালের প্রতিনিধিরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, অনেক ল্যাব স্থাপনের পর চালু করা হয়নি। কয়েকটি ল্যাবের যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে গেছে। ফলে একদিকে রোগীর ভোগান্তি বাড়ছে, অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে গিয়ে কয়েক গুণ টাকা গুনতে হচ্ছে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, করোনাভাইরাস দুইভাবে শনাক্ত করা যায়। মহামারির শুরুতে র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন কিটের মাধ্যমে এই ভাইরাস পরীক্ষা শুরু হয়। এরপর ২০২০ সালে দেশজুড়ে রোগ নির্ণয় ক্ষমতা বাড়াতে কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্পের আওতায় সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে ১৬২টি আরটি-পিসিআর (রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন টেস্ট) ল্যাব স্থাপন করা হয়। করোনা সংক্রমণ কমে গেলে এসব ল্যাবের অধিকাংশ বন্ধ হয়ে যায়। গত বছরের ডিসেম্বরে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের ১ হাজার ৪ জন অস্থায়ী জনবলকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়। 

করোনাভাইরাস বাড়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত মে মাসে সরকারি হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করার নির্দেশ দেয়। গত এক মাসে মাত্র ২১টি আরটি-পিসিআর ল্যাবে এই পরীক্ষা চালু হয়েছে। বাকি ১৪১টি ল্যাব জনবল সংকটসহ নানা অব্যবস্থাপনায় অকার্যকর। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা ও অদূরদর্শিতায় এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। ল্যাব স্থাপনের সময় প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ, নিয়মিত রিএজেন্ট সরবরাহ নিশ্চিত করা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং রক্ষণাবেক্ষণের মতো বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ল্যাব তৈরি হলেও সেখানে প্রয়োজনীয় টেকনোলজিস্ট বা প্যাথলজিস্ট নেই। আবার কোথাও রিএজেন্ট না থাকায় বা নিয়মিত সরবরাহ না পাওয়ায় ল্যাবগুলো চালু হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. মঈনুল আহসান বলেন, করোনার মধ্যে বিশ্বব্যাংকের টাকায় সারাদেশে ১৬২টি আরটি-পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হয়। তখনই এ যন্ত্রের কিট হাসপাতাল প্রশাসনকে নিজ ব্যবস্থাপনায় কেনার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে অর্থ সংকট থাকায় তা করতে পারেনি। অনেক জায়গায় জনবল সংকটও রয়েছে। 

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল বায়োকেমিস্টের (বিএসিবি) যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ফাতেমা খান মজলিশ বলেন, নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় বা অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধি নির্ণয়ে এই ল্যাবগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। অথচ সেই সম্ভাবনাময় অবকাঠামো অব্যবস্থাপনার শিকার। এই বিশাল সংখ্যক অকেজো ল্যাবকে কার্যকর করতে হলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। 

তিনি বলেন, কেন ল্যাবগুলো অচল, তার কারণ খুঁজে বের করতে প্রয়োজনে তদন্ত করা উচিত। দায়ীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান, প্যাথলজিস্ট এবং অন্যান্য কর্মী নিয়োগ করা দরকার। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গতকাল সোমবার দেশে আরও ২১ জনের শরীরে ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৫৬৯ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়ে তাদের মধ্যে ২২ জন মারা গেছেন। 

গতকাল পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৮৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। শনাক্তের হার ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ২০ লাখ ৫২ হাজার ১১৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। আর দেশে ভাইরাসটিতে মোট মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৫২১ জনের।

উল্লেখযোগ্য যেসব হাসপাতালে আরটি-পিসিআর যন্ত্র অচল
রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান-নিপসম, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল উল্লেখযোগ্য।

তিন বছর ধরে বাক্সবন্দি আরটি-পিসিআর যন্ত্র
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১৫ জুলাই বান্দরবান সদর হাসপাতালে একটি আরটি-পিসিআর যন্ত্র দেওয়া হয়। যন্ত্রটি স্থাপন করতে পরীক্ষাগার (ল্যাব) ও পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল না থাকায় তিন বছর ধরে তা বাক্সবন্দি। একাধিকবার জনবল চেয়ে চিঠি দেওয়া হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সাড়া দেয়নি। 

সদর হাসপাতালের সামনে ছোট আকারের একটি দ্বিতল ভবনে আরটি-পিসিআর যন্ত্রটি রাখা হয়েছে। এটি স্থাপনে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত তিনটি ‘বায়োসেফ’ কক্ষ, আসবাবসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। পরীক্ষাগার পরিচালনায় তিনজন কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ, ছয়জন ল্যাব টেকনিশিয়ানসহ ২১ জনের প্রশিক্ষিত জনবল দরকার। 
বান্দরবান সদর হাসপাতালের নির্মাণাধীন ভবনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আরটি-পিসিআর যন্ত্র স্থাপনের জায়গা পাওয়া যাবে না বলে জানান চট্টগ্রাম বিভাগের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের চিকিৎসা কর্মকর্তা থোয়াই অং চিং মারমা।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস ও ম্যালেরিয়ার উচ্চ ঝুঁকির জেলা হিসেবে শনাক্ত বান্দরবানে আরটি-পিসিআর ল্যাব চালু করা জরুরি। কিট দিয়ে পরীক্ষা করলে অনেক সময় ম্যালেরিয়া শনাক্ত করা যায় না। আবার শনাক্ত করা গেলেও কোন ধরনের ম্যালেরিয়া, চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। আরটি-পিসিআর যন্ত্রে পরীক্ষা করে ম্যালেরিয়ার ধরন জানা সম্ভব হলে চিকিৎসা করাও সহজ। প্রতিদিন ১০-১২ জন করোনার লক্ষণ নিয়ে এলেও পরীক্ষার জন্য বেসরকারি ক্লিনিকে পাঠাতে হচ্ছে।
বান্দরবানের সিভিল সার্জন মাহবুবুর রহমান বলেছেন, আরটি-পিসিআর যন্ত্রটি চালুর বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। এখনও সাড়া মেলেনি।

ল্যাবের যন্ত্রাংশ চুরি
করোনা মহামারি মোকাবিলায় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল চত্বরে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয়েছিল পিসিআর ল্যাব। এটি দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। পিসিআর ল্যাবের পেছন দিকের গ্রিল কেটে চোরচক্র পিসিআর মেশিন, পিসিআর মনিটর, পিসিআর ডেস্কটপ, ইনডোর এসি, আউটডোর এসিসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি চুরি করে নিয়ে গেছে। 

গত ১২ মে টেকনোলজিস্ট খাইরুল ইসলাম কুষ্টিয়া মডেল থানায় চুরির অভিযোগ করেন। এখনও কাউকে ধরতে পারেনি পুলিশ।

কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবুর রহমান খান বলেন, সম্প্রতি পিসিআর ল্যাবটি একাডেমিক ভবনের ষষ্ঠতলায় স্থানান্তরের উদ্যোগ নিই। মে মাসে ওই ল্যাবে গেলে চুরির বিষয়টি নজরে আসে। সেখানে তিনটি পিসিআর মেশিনের মধ্যে দুটি অব্যবহৃত, একটি ব্যবহৃত হয়েছিল। ব্যবহৃত পিসিআর মেশিনসহ আরও কিছু সরঞ্জাম চুরি হয়েছে পেছন দিকের গ্রিল কেটে। অব্যবহৃত পিসিআর মেশিন মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের তত্ত্বাবধানে মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসা হয়েছে। আরও একটি নতুন পিসিআর মেশিন আমরা পেয়েছি। তবে কিট সংকটে এই মেশিনও চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।

দিনাজপুর রংপুর মেডিকেলে বন্ধ করোনা পরীক্ষা
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকা তিনটি আরটি-পিসিআর ল্যাবের যন্ত্র তিন বছর ধরে বিকল। বন্ধ রয়েছে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা। রংপুর স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে করোনা পরীক্ষার জন্য কোনো কিট নেই।

রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. শাহীন সুলতানা বলেন, কিটসহ অন্যান্য উপকরণ এলে নমুনা সংগ্রহ ও করোনা পরীক্ষার কাজ শুরু হবে। বিভাগীয় স্বাস্থ্য কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রোকেয়া খাতুন বলেন, পিসিআর মেশিনগুলো সচল করার চেষ্টা চলছে। আশা করছি, দ্রুতই সম্ভব হবে। সব জেলার সিভিল সার্জনকে নিয়ে সভা করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়াসহ করোনা প্রতিরোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

একই অবস্থা হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালেও। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আমিনুল হক সরকার বলেন, চাহিদা থাকলেও হাসপাতালে বরাদ্দ থাকা কিটের সংখ্যা মাত্র ২৫০, যার মেয়াদ শেষ হবে আগামী সেপ্টেম্বর মাসে। অক্সিজেন ছাড়া অন্যান্য সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে। ইতোমধ্যে কিটসহ সরঞ্জামের চাহিদাপত্র সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

খুলনা মেডিকেল কলেজের পিসিআর যন্ত্র নষ্ট
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা শনাক্তের যন্ত্রটি ২০২৩ সালের ২৭ নভেম্বর বিকল হয়; আর চালু হয়নি। এখানে দৈনিক ২৮২টি নমুনা পরীক্ষা করা হতো। এখন র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন কিট দিয়ে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। 

খুলনা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ এবং করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা টেকনিক্যাল কমিটির সমন্বয়কারী ডা. মেহেদী নেওয়াজ জানান, পিসিআর ল্যাবের বড় মেশিনটি সচল করতে কিট প্রয়োজন। কিট চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এলে আবার পরীক্ষা শুরু হবে।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নাজমুল হোসেন বলেন, ঢাকার বাইরে ১১টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে তাদের আরটি-পিসিআর পরীক্ষার সুবিধা চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে এগুলো চালু হবে। দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় এসব যন্ত্রপাতি এখন ক্যালিব্রেশন করতে কিছুটা সময় লাগছে বলে জানান তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, করোনাভাইরাস এখনও উদ্বেগজনক হারে বাড়েনি। এসব যন্ত্র সচল করতে জনবল ও কিট প্রয়োজন। আমরা কিট কেনার চেষ্টা করছি। তবে জনবল নতুন বরাদ্দ ছাড়া নেওয়া সম্ভব নয়। জনবল বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আশা করি, দ্রুত সমাধান হবে।

গতরাতে যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সাইদুর রহমান বলেন, যেসব আরটি-পিসিআর মেশিন অচল আছে, সেগুলো সচল করতে একটি প্রকল্প নেওয়া হবে। এর অধীনে জনবল নিয়োগসহ কিট, রিএজেন্ট ইত্যাদি কেনা হবে। তার আগ পর্যন্ত এই ল্যাবগুলো সচল করা যাচ্ছে না। 
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সমকালের প্রতিনিধিরা)

আরও পড়ুন

×