ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

রাষ্ট্রপতির ক্ষমার ক্ষমতা কমাতে সব দল একমত

রাষ্ট্রপতির ক্ষমার ক্ষমতা কমাতে সব দল একমত

.

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫ | ০১:৫৩ | আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৫ | ১০:৩১

রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা কমাতে সংশোধন করা হবে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ। দণ্ডিত অপরাধীকে ক্ষমা করতে নিতে হবে ভুক্তভোগীর মতামত, দিতে হবে ক্ষতিপূরণ। বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণে সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নবম দিনের সংলাপে এসব বিষয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। 

বিএনপি বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপনের প্রস্তাব করলেও অন্য দলগুলো স্থায়ী বেঞ্চ গঠনের প্রস্তাব করে। বিএনপি তা মেনে নেয়। তবে দলটি প্রস্তাব করেছে, আপিল বিভাগের সঙ্গে পরামর্শ করে ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা উচিত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে পরিচিত বিচারক ও বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। এতে অন্যান্য দল সমর্থন করেছে। 

সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যে কোনো ব্যক্তির সাজা মওকুফ, স্থগিত করতে পারেন রাষ্ট্রপতি। তবে ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের কারণে আদতে তা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই হয়। এ ক্ষমতায় লাগাম টানতে দণ্ডিত ব্যক্তি ক্ষমার যোগ্য কিনা, তা নির্ধারণে সুপারিশ কমিটি বা বোর্ড গঠনের প্রস্তাবে ঐকমত্য হয় সংলাপে। জামায়াত প্রস্তাব করে, ব্যক্তিগত অপরাধের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী বা তার পরিবারের অনুমতি ছাড়া অপরাধীকে ক্ষমা করা যাবে না। ভুক্তভোগীকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বিএনপি, এনসিপিসহ অধিকাংশ দল এ প্রস্তাবে সায় দেয়।

হাইকোর্ট ঢাকার বাইরে নিতে ঐকমত্য
সংলাপের পর কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠায় ঐকমত্য হয়েছে। ১০০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে যোগ করা হবে, ‘রাজধানীর বাইরে প্রতিটি বিভাগে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক নির্ধারিত হাইকোর্ট বিভাগের এক বা একাধিক স্থায়ী বেঞ্চ থাকবে’।

এরশাদ সরকার ১৯৮৯ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ও চার বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপন করেছিলেন। পরের বছরে আপিল বিভাগ এ সংশোধনীর একাংশকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ এক কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র হওয়ায় রাজধানীর বাইরে হাইকোর্ট বেঞ্চ অসাংবিধানিক। 

এ রায় থাকলেও গত অক্টোবরে গঠিত বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ পুনঃস্থাপনের প্রস্তাব করে। অষ্টম সংশোধনীর রায়ের নজির দিয়ে বিএনপি বলেছিল, স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা যাবে না। সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করা যেতে পারে।   

বিএনপির প্রস্তাবিত সার্কিট বেঞ্চের বিরোধিতা করে জামায়াত পুরোনো চার বিভাগে স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের প্রস্তাব করে। এনসিপিসহ অধিকাংশ দল বিভাগীয় পর্যায়ে স্থায়ী বেঞ্চ করার প্রস্তাব করে।

এই পর্যায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সব বিভাগীয় শহরে স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের ঐকমত্য হলে বিএনপিও রাজি। তিনি সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার পরামর্শ দেন। জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বিএনপির এই প্রস্তাবে সমর্থন করেন। তবে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনসহ কয়েকজন সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
 
হাসিনা আমলে ২৭ ফাঁসির আসামিকে ক্ষমা
সংলাপে এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ জানান, আওয়ামী লীগ শাসনামলে হত্যায় মামলায় দণ্ডিত ২৭ ফাঁসির আসামিকে ২৮ বার রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করেছেন। এক আসামি দু’বারও ক্ষমা পেয়েছেন। সব আসামি ছিলেন আওয়ামী লীগের। 

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমার অপপ্রয়োগ হয়েছে। ফাঁসির আসামিকে ছেড়ে দিয়ে হত্যাযজ্ঞের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। তাই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এর নিয়ন্ত্রণে বিএনপি একমত। ডা. তাহের বলেন, হত্যার মতো অপরাধে ভুক্তভোগী পরিবারের সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্রপতি বা কমিটি এককভাবে সাজা মাফ করতে পারবে না। এতে ইনসাফ নিশ্চিত হবে। আখতার হোসেন বলেন, অতীতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার নামে শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবারকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। 

আলী রীয়াজ জানান, যে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, তা ভবিষ্যতে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। এতে ক্ষমা প্রদর্শনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ হবে।

আদালতকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করতে হবে
সংলাপে সব রাজনৈতিক দল বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় একমত হয়েছে। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন বলেন, স্বাধীনতার সুফল জনগণ ভোগ করতে উচ্চ ও নিম্ন আদালতকে ফ্যাসিস্টমুক্ত করতে হবে। পরিষ্কার বক্তব্য, আদালতকে ফ্যাসিস্টমুক্ত করতে হবে। তার পরে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা সত্যিকার অর্থে কার্যকর হবে। 

তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সাংবাদিকসহ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ফ্যাসিবাদের দোসর বিচারকরা অবৈধ সাজা দিয়েছেন। স্বাধীনতা দিয়ে এই বিচারকরা যেন রক্ষা না পান। বদলি কিংবা বিভাগীয় ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। শুধু চাকরি গেলে হবে না, ফৌজদারি ব্যবস্থা নিতে হবে। তা নিশ্চিত হলে, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা কার্যকর হবে। নইলে স্বাধীনতা ফ্যাসিস্টরা ভোগ করবে। 

সালাহউদ্দিন বলেন, জেলা পর্যায়ে থেকে হাইকোর্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের যারা দোসর ছিল, যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সব তো জামিন হয়ে যাচ্ছে। এসব ফ্যাসিস্টের দোসররাই করছে। 

ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে বিএনপি বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ চায় জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, এ ক্ষেত্রে  প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ জরুরি। সবার মঙ্গল ও সুবিধার জন্য আমরা বলেছি। অষ্টম সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণার রায়ের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, সংবিধানে এমন পরিবর্তন করতে পারব না, যা পরবর্তী সময়ে টিকবে না। 

আগামী সোমবার আবার সংলাপ শুরু বলে জানিয়েছেন আলী রীয়াজ। তিনি জানান, দ্বিতীয় ধাপের ৯ দিনের সংলাপে ১৩টি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পাঁচটিতে ঐকমত্য হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।  

 

আরও পড়ুন

×