ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে উত্তাল দেশ

মৌলবাদের ঠাঁই নেই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে

মৌলবাদের ঠাঁই নেই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে

কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্রলীগ -সমকাল

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৫:৪১

কুষ্টিয়ায় নির্মাণাধীন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে সারাদেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে। গতকাল রোববার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল ও মানববন্ধন থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা এবং ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতাকারী সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। হাজারো মানুষ এসব কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সোচ্চার কণ্ঠে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে মৌলবাদের ঠাঁই নেই।

এদিন সকাল থেকে দিনভর রাজধানীর রাজপথে অবস্থান নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে আওয়ামী লীগ, জাসদ এবং এসব দলের সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনসহ বিভিন্ন দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো। বিক্ষোভ কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী স্লোগানে স্লোগানে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা কাঁপিয়ে তোলেন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক থেকেও এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। পৃথক বিবৃতিতে বিভিন্ন দল ও সংগঠন সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে।

সংসদীয় কমিটির নিন্দা: গতকাল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কুষ্টিয়ায় রাতের আঁধারে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়।

বৈঠক শেষে সংসদীয় কমিটির সভাপতি শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামের নামে নারী ধর্ষণ, ২০১৫ সালে আন্দোলনের নামে কোরআন শরিফ পুড়িয়ে ফেলা ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা এবং ভাস্কর্য নির্মাণে বিরোধিতা একই সূত্রে গাঁথা। তারা অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে ভাস্কর্যকে ইস্যু করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা করছে। সংসদীয় কমিটি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে সব চক্রান্ত ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার কথা বলেছে।

শাজাহান খানের সভাপতিত্বে বৈঠকে অংশ নেন কমিটির সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক, কমিটির সদস্য এবি তাজুল ইসলাম, কাজী ফিরোজ রশীদ, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল এবং মোছলেম উদ্দিন আহমদ।

রাজধানীজুড়ে বিক্ষোভ: বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করে। ঢাকা মহানগর জাসদের যুগ্ম সমন্বয়ক নুরুল আক্তারের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন দলের সহসভাপতি শহিদুল ইসলাম, সফি উদ্দিন মোল্লা, রোকনুজ্জামান রোকন, সাইফুজ্জামান বাদশা, শরিফুল কবির স্বপন, রাশেদুল হক ননী প্রমুখ।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে মহিলা আওয়ামী লীগ। সংগঠনের সভাপতি সাফিয়া খাতুন ও সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম কৃকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা কর্মসূচিতে অংশ নেন। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ এর আওতাধীন ৬৫টি ওয়ার্ডে একযোগে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচিসহ নেতারা এসব কর্মসূচিতে যোগ দেন।

যুবলীগ সারাদেশের জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা, পৌরসভা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে সারাদিন রাজপথে অবস্থান এবং বিকেল ৩টায় একযোগে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। এর অংশ হিসেবে রাজধানীর ফার্মগেট ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল হয়েছে। ফার্মগেটে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলসহ নেতারা বক্তব্য দেন। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য দেন অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ, মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন এমপি, তাজউদ্দিন আহমেদ, রফিকুল ইসলাম, বিশ্বাস মতিউর রহমান বাদশা, রফিকুল ইসলাম সৈকত জোয়ার্দার, সাইফুর রহমান সোহাগ, জহির উদ্দিন খসরু, জয়দেব নন্দী, মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ, জাকির হোসেন বাবুল, মাইনউদ্দিন রানা, ইসমাইল হোসেন, এইচএম রেজাউল করিম রেজা প্রমুখ।

বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে সংগঠনের সভাপতি নির্মল রঞ্জন গুহ, সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু, কেন্দ্রীয় নেতা গাজী মেসবাউর রহমান সাচ্চু, নির্মল চ্যাটার্জী, আব্দুল আলিম, কেএম মনোয়ারুল ইসলাম বিপুল, মেহেদি হাসান মোল্লা, আজিজুল হক, কামরুল হাসান রিপন, সাঈদ প্রমুখ বক্তব্য দেন।

যুব মহিলা লীগ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। এতে সংগঠনের সভাপতি নাজমা আক্তার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিলসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা বক্তব্য দেন। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এলাকায় জাতীয় শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, মৎস্যজীবী লীগ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে ছাত্রলীগ। সমাবেশে বক্তব্য দেন ছাত্রলীগের সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয়, সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন, ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান হৃদয়, দক্ষিণের সভাপতি মেহেদী হাসান, সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের আহমেদ প্রমুখ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে সামাজিক সংগঠন 'অপরাজেয় বাংলা'। সমাবেশ থেকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভাস্কর্য ভাঙচুর ও বিরোধিতাকারী ও উস্কানিদাতা হেফাজত নেতা মামুনুল হক গংয়ের গ্রেপ্তারের আলটিমেটাম দেওয়া হয়।

বিবৃতিতে নিন্দা-প্রতিবাদ: বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি এক বিবৃতিতে বলেন, রাষ্ট্রদ্রোহ এসব রাজনৈতিক মোল্লা, ফতোয়াবাজ ও তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

পৃথক বিবৃতিতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তিকে প্রতিরোধ করতে হলে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের সংগ্রামকে বেগবান করতে হবে। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার মানুষকেও ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বিবৃতিতে বলেন, ভোটের স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতাকে পৃষ্ঠপোষকতা, পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাস পরিবর্তন, বিভিন্ন রকম অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করার ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তি আজ কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের মতো অপতৎপরতা দেখাতে পারছে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ মদদ ও ইন্ধনে মৌলবাদী জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। যে কোনো মূল্যে তাদের প্রতিহত করা হবে।

সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের বিবৃতিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ভাস্কর্য ভাঙচুর ও বিরোধিতাকারী অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলারও আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিদাতারা হলেন- মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ বীরউত্তম, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নুরুল আলম, কর্নেল (অব.) সামসুল আলম, ডা. সারওয়ার আলী, ম হামিদ, হারুন হাবীব, আবুল কালাম আজাদ পাটোয়ারী, মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার, শাহজাহান মৃধা বেনু, আব্দুল মাবুদ, ডা. মোহাম্মদ মনসুর, আবুল হাসিম ভূঁইয়া ও মীর আসালত।

বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির (এপিইউবি) চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বিবৃতিতে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার মাধ্যমে দেশের হাজার বছরের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিনষ্টের অপচেষ্টা করা হচ্ছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে উন্নয়নবিমুখ মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার হীন উদ্দেশ্য এ দেশের শিক্ষিত সমাজ সফল হতে দেবে না।

বীমা কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পৃথক বিবৃতিতে শেখ কবির হোসেন বলেন, যে মহান নেতা জাতির কল্যাণে সারাজীবন কাজ করে গেছেন, জীবনের প্রায় ১৩টি বছর কারাগারের অন্ধকারে কাটিয়েছেন, যার জন্ম না হলে বাংলাদেশ কখনও স্বাধীনতা লাভ করত না, যিনি বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছেন- সেই মহান নেতার ভাস্কর্য ভাঙা খুবই দুঃখজনক এবং বেদনাদায়ক। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন জাতির পিতাকে নিয়ে এ ধরনের ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস না পায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক লুৎফর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নিজামুল হক ভুইয়া বিবৃতিতে বলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসম্মান ও অবমাননা বাঙালি জাতি সহ্য করবে না। পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতির পিতার সর্বোচ্চ অবস্থান ধরে রাখার জন্য সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নেবে।

আরও পড়ুন

×