যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল
দীর্ঘদিন বন্ধ বিচার তদন্ত ও অনুসন্ধান

ওয়াকিল আহমেদ হিরন
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২১ | ১২:০০
গত আট মাসে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের কোনো মামলায় রায় আসেনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ১৬ মাস ধরে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা থেকে কোনো নতুন মামলার প্রতিবেদন জমা পড়েনি। সর্বশেষ ২০২০ সালের ১২ আগস্ট নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ ও কবিরহাট উপজেলার চারজনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে তদন্ত সংস্থা। বিচার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এবং তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়ায় অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে আছেন প্রসিকিউশন।
এদিকে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের বিচারক আমীর হোসেন গত ২৪ আগস্ট মারা যান। এতে একটি সদস্য পদ শূন্য হয়। আইন অনুযায়ী দু'জন সদস্য দিয়ে এর বিচার কাজ চালানোর সুযোগ নেই। তাই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের জন্য একজন বিচারপতি নিয়োগ দিতে প্রধান বিচারপতির কার্যালয় থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠানো হয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমকে ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই দায়িত্ব নেবেন তিনি।
ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় ৪৭২টি অভিযোগ ঝুলছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা দুই হাজার ৭৪৪ জন। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষে বর্তমানে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় স্থানীয় তৃণমূল যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে জমা পড়া সাত শতাধিক অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজ থমকে আছে। বর্তমানে যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে আগামী ১০ বছরেও এই সাত শতাধিক অভিযোগ নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। একদিকে তদন্ত সংস্থায় জনবল সংকট, অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের মামলা নিষ্পত্তির গতিও এর বড় কারণ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রতি বছর গড়ে চার থেকে পাঁচটি রায় হয়ে থাকে। কিন্তু গত পৌনে দুই বছরে মাত্র একটি মামলার রায় হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সংস্থার সংশ্নিষ্টরা জানান, মুজিববর্ষে একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া হয়েছিল- লক্ষ্য ছিল যাচাই-বাছাই শেষে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ অভিযোগ নিষ্পত্তি করা। কিন্তু গত বছর মার্চ থেকে দেশে মহামারি করোনাভাইরাস বেড়ে যাওয়ায় তা আর করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ চলতি বছর ১১ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের গফরগাঁও এবং ভালুকার আট রাজাকারকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে তিন আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং পাঁচ আসামিকে ২০ বছর করে সাজা দেওয়া হয়। এরপর আর কোনো রায় হয়নি। অবিলম্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চালুর দাবি জানিয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির সমকালকে বলেন, শুধু প্রথমটি নয়, দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালও কার্যকর করতে হবে। অপরাধী, সাক্ষী ও বিচারপ্রত্যাশীদের বয়স হয়েছে। তারা মারা যাচ্ছেন। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, বিচার যদি না-ই করতে পারেন, তাহলে কেন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল? মাত্র ১১ বছরেই ট্রাইব্যুনালকে 'ঠুঁটো জগন্নাথ' বানানো হয়েছে।
তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এম সানাউল হক বলেন, করোনার কারণে অনেক দিন মাঠ পর্যায়ে তদন্ত কাজ বন্ধ ছিল। এখন কিছুটা চালু হয়েছে। বিচার না চলায় অনেক বিচারপ্রার্থী হতাশায় ভুগছেন। কারণ সাক্ষী ও আসামিদের বয়স হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক সাক্ষী ও আসামির মৃত্যু হয়েছে। যেসব আসামি বেঁচে আছেন, তাদের বিষয়ে দ্রুত তদন্ত না হলে এদেরও স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে।
তিনি বলেন, দ্রুতই দু-তিনটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। ৭৯০টি অভিযোগের মধ্যে গত ১১ বছরে যাচাই-বাছাই করে মোট ৭৮টি মামলার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। জনবল সংকটের কারণে তদন্ত কাজে দেরি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ শিমন বলেন, বিচার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আমরা মামলাগুলো স্টাডি করছি। খুব শিগগিরই কয়েকটি রায় পাওয়া যাবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এখন পর্যন্ত ৪২টি মামলায় ১০৩ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজার রায় হয়েছে। এর মধ্যে ৭১ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। বিচারাধীন আছে ৩৮টি মামলা, যেগুলোর আসামি সংখ্যা ২৩২ জন। এ ছাড়া আপিল ও রিভিউ শেষে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০টি মামলা। যার মধ্যে ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। রায় ঘোষণা অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত ৪২ যুদ্ধাপরাধী পলাতক।