ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

অপহরণ ও গুমের ঘটনা থেমে থাকেনি করোনাকালেও: আসক

অপহরণ ও গুমের ঘটনা থেমে থাকেনি করোনাকালেও: আসক

২০২১ সালের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে শুক্রবার সকালে ডিআরইউতে সংবাদ সম্মেলন করে আসক। ছবি-সমকাল

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ | ০১:২৯ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ | ০৪:০৬

করোনা মহামারীকালে রাষ্ট্রের নানা সঙ্কটের মধ্যেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ক্রসফায়ার বা কথিত বন্দুকযুদ্ধসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বছরের বিভিন্ন সময়ে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুমের ঘটনা থেমে থাকেনি ২০২১ সালে।

 ২০২১ সালের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে শুক্রবার সকালে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসক।

সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আসকের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির ও সহকারী সমন্বয়কারী অনির্বাণ সাহা। 

বক্তব্য দেন আসক নির্বাহী কমিটির মহাসচিব মো. নূর খান, নির্বাহী পরিচালক গোলাম মানোয়ার কামাল ও পরিচালক নীনা গোস্বামী।

তারা জানান, গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৮০ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৫১ জন।

ক্রসফায়ারের সমর্থনে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের বক্তব্যের সমালোচনা করে আসক বলে, ‘তাদের এ ধরণের বক্তব্য প্রকারান্তরে বিচারবহির্ভূত হত্যা বা ক্রসফায়ারকেই উৎসাহিত করে। এটা প্রকৃতপক্ষে দেশের সংবিধান প্রদত্ত মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার হরণসহ আইনে আশ্রয় লাভ সংক্রান্ত সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থি। একইসাথে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে জাতিসংঘের মানবাধিকার ব্যবস্থায় প্রদত্ত বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গীকারের সাথে সাংঘর্ষিক।’

আসক জানায়, ২০২১ সালে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নিহত হয়েছেন ৮ জন। এর মধ্যে গ্রেপ্তারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শারীরিক নির্যাতনে ৬ জন, হার্ট অ্যাটাকে ১ জন ও গ্রেপ্তারের আগে শারীরিক নির্যাতনে ১ জন নিহত হয়েছেন। এ বছর দেশের কারাগারগুলোতে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন ৮১ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২৯ জন, হাজতি ৫২ জন। 

আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হন ৭ জন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৬ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ১ জন।

২০২১ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএসফের গুলিতে ১৮ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। 

বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ঘটনায় গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ২৮ জন।

আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৩২১ জন নারী। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ১২৮ নারী।  এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন ৭৭ পুরুষ। 

এ বছর উত্ত্যক্তের ঘটনায় আত্মহত্যা করেছেন ১২ নারী। 

এ বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬৪০ জন; যার মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ৩৭২ জন, আত্মহত্যা করেন ১৪২ জন। 

২০২১ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২১০ নারী।  এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হন ৭২ নারী, আত্মহত্যা করেছেন ১৩ নারী।

২০২১ সালে সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে ১২ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। 

রাজনৈতিক সহিংসতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আসক জানায়, এ বছর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ মোট প্রায় ৯৩২টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটে। 

এসব রাজনৈতিক সংঘাতে ১৫৭ জন নিহত ও ১০ হাজা র৮৩৩ জন আহত হয়েছেন। এছাড়াও পৌর ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে ৮৩টি ঘটনায় ১৩ জন নিহত ও ৭৮৮ জন আহত হয়েছে।

২০২১ সালে ১৪৪ ধারা জারির ঘটনা ঘটেছে কমপক্ষে ২০ বার।

আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার পরিস্থিতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদ্বেগজনক ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নানা উস্কানিমূলক অপপ্রচারের মাধ্যমে সারাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়িয়ে দেওয়া হয়। 

এ বছর দুর্গা পূজা চলাকালীন সময়ে কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পূজা মন্ডপে ও মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর, বাড়িঘর ও দোকানপাটে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। নোয়াখালীতে একজনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ আসে।  এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসক। 

শিশু অধিকার বিষয়ে আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে ৫৯৬ জন শিশু নিহত হয়েছেন। 

আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যক্তি , জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতন, হামলা, মামলা, হুমকি ও হয়রানিসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২১০ জন সাংবাদিক। 

আসক বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এ বছরও ভিন্নমতকে দমন করার লক্ষ্যে হয়রানিমূলক মামলা, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের নানা ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। 

২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে ১১৩৪টি।

অনুষ্ঠান শেষে এক প্রশ্নের জবাবে মো. নূর খান বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের যতটুকু সহ্য করার ক্ষমতা থাকে, তা প্রায় অতিক্রম হতে চলেছে। বিদায়ী বছরে মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে।’






 

 



আরও পড়ুন

×