অভিযান-১০ লঞ্চের মালিক-চালকদের দায়ী করে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন

ফাইল ছবি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২২ | ০১:৩০ | আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২২ | ০৯:১৪
ঝালকাঠির সন্ধ্যা নদীতে যাত্রাবাহী লঞ্চ 'এমভি অভিযান-১০' এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা পড়েছে।
মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া এই প্রতিবেদনে ওই অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে ২৫ দফা সুপারিশও করা হয়েছে।
এই তদন্ত প্রতিবেদন কিছুদিনের মধ্যে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবেন বলে নৌ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে।
মঙ্গলবার নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনে যাদেরই দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী মঙ্গলবার সমকালকে জানিয়েছেন, সোমবার রাতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। এটি নৌ প্রতিমন্ত্রী মহোদয় আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করবেন। তবে সংবাদ সম্মেলনের দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
তিনি জানান, তদন্ত প্রতিবেদনে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে কিছু সুপারিশও করা হয়েছে।
তবে নৌ প্রতিমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের আগে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে সম্মত হননি নৌসচিব।
ঢাকা-বরগুনা নৌপথের ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী ‘এমভি অভিযান-১০’ লঞ্চে গত ২৪ ডিসেম্বর স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৭ জনে। এখনও বেশ কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন।
আগুনে দগ্ধদের মধ্যে অনেকেও বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
ওই দুর্ঘটনার দিনই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তোফায়েল ইসলামকে আহ্বায়ক ও উপ-সচিব আমিনুর রহমানকে সদস্য সচিব করে গঠিত এই তদন্ত কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল। তবে এই সময়ের মধ্যে তদন্ত কাজ শেষ করতে না পারায় এর মেয়াদ আরও তিন কার্যদিবস বাড়ানো হয়। তদন্ত শেষে সোমবার রাতে তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।
ওই দুর্ঘটনার বিষয়ে আরও দু'টি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন গঠিত ওই দু'টি কমিরি তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা দেয়া হয়নি।
প্রতিবেদনে যা আছে
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত প্রতিবেদন বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে চাননি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
তবে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই তদন্ত প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের জন্য লঞ্চটির সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের দায়ী করে প্রতিবেদন দিয়েছে তদন্ত কমিটি। বিশেষ করে লঞ্চের মাস্টার ও চালকসহ লঞ্চ পরিচালনা সংক্রান্ত কর্মচারী ও লঞ্চের কর্মীরা এর জন্য মূলত দায়ী বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যাত্রীবাহী লঞ্চটির মালিকপক্ষের অবহেলা ও গাফিলতিকেও এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানিয়েছে, তদন্ত কার্যক্রম চলাকালে তদন্ত কমিটির সদস্যরা ক্রটিপূর্ণ ইঞ্জিনের কারণে যাত্রাবাহী লঞ্চ ‘এমভি অভিযান-১০’ এ আগুন লাগে বলে দেখতে পেয়েছেন। তবে লঞ্চের কর্মীরা ইঞ্জিনে ক্রটি দেখার পরও কোনো ব্যবস্থা নেননি এবং আগুন লাগার পর সেটি নেভাতেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তদন্ত কমিটি দেখতে পেয়েছেন, নৌপরিবহন অধিদপ্তরের অনুমতি না নিয়েই লঞ্চের মালিক ইঞ্জিন পরিবর্তন করেছেন।
এজন্য ঢাকা নদীবন্দরের সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে কর্মরত নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কয়েকজন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা ছিল। অবশ্য এর আগেই লঞ্চটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নৌআদালতে করা মামলায় তিন মালিক ও দুই মাস্টার-চালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া তিন মালিক হচ্ছেন হামজালাল শেখ, শামীম আহমেদ ও রাসেল আহম্মেদ।
এছাড়া লঞ্চের ইনচার্জ চালক মাসুম বিল্লাহ ও দ্বিতীয় চালক আবুল কালাম নৌআদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাদের জামিন না-মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
২৫ সুপারিশে আগাম সতর্কতার তাগিদ
নৌ মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে ২৫টি সুপারিশ করা হয়েছে।
এসব সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে রোটেশন পদ্ধতিতে লঞ্চ চলাচল বন্ধ, লঞ্চ ছাড়ার আগে যথাযথভাবে পরিদর্শন, ঘন ঘন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং লঞ্চের কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান।
প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্ঘটনা রোধে সতর্কতামূলক বিষয়গুলো কঠোরভাবে মেনে চলার তাগিদ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে কোনা ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত কিংবা দুর্ঘটনার আশঙ্কা টের পাওয়া মাত্রই এ ব্যাপারে আগেভাগে যাত্রীদের জানাতে বলা হয়েছে।
এছাড়া প্রতিবেদনে যাত্রীবাহী লঞ্চের ইঞ্জিন পরিবর্তন বিষয়েও কঠোর নীতিমালা অনুসরণের সুপারিশ করা হয়েছে। বিশেষ করে চাইলেই কেউ যেন ইঞ্জিন কিংবা এর যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করতে না পারেন- সে বিষয়ে কঠোর মনিটরিং করতে বলা হয়েছে। আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য কেউ দায়ী বলে চিহ্নিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সুপারিশও করা হয়েছে।
নৌ মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও যুগ্ম সচিব তোফায়েল ইসলাম তদন্ত প্রতিবেদন বিষয়ে বিস্তারিত না জানিয়ে বলেন, তদন্তকালে তারা ওই দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ এবং এর জন্য দায়ীদের চিহ্নিতকরণের চেষ্টা করেছেন। সে অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। এতে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু সুপারিশও তুলে ধরেছেন তারা।