ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

পুরোনো ধাঁচে নতুন নির্বাচন কমিশন

পুরোনো ধাঁচে নতুন নির্বাচন কমিশন

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৪:২৯

সপ্তাহ দুয়েক আগে বিদায় নেওয়া নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা। কমিশনার হিসেবেও ছিলেন দু'জন সাবেক আমলা, সঙ্গে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত নারী জেলা জজ। নতুন নির্বাচন কমিশনও গঠিত হলো একই ধাঁচে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) পদে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল। চার কমিশনার পদে নিয়োগ পেয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান এবং সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান।

সার্চ কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ আগামী পাঁচ বছরের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে তাদের নিয়োগ দিয়েছেন। গতকাল শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আজ রোববার তাদের শপথ নেওয়ার কথা রয়েছে।

দেশের ত্রয়োদশ সিইসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন এই কমিশনের অধীনেই আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নিয়োগ পাওয়ার পরপরই এক প্রতিক্রিয়ায় নবনিযুক্ত সিইসি বলেন, সব দলের প্রতি সমআচরণ নিশ্চিত করতে তিনি কাজ করবেন। বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আনাই তার প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেন।

বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন ১৪ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেওয়ার পর থেকে সাংবিধানিক সংস্থাটির এই পদগুলো শূন্য ছিল।

স্বাধীনতার পর এই প্রথমবারের মতো আইনের অধীনে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি এই আইনের অধীনে যোগ্য লোক খুঁজতে আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গত বৃহস্পতিবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ১০ জনের নাম সুপারিশ করে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচন কমিশন গঠনের এই পুরো প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখে। এ প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, 'সরকার আরও একটি তামাশার নির্বাচন আয়োজন করতে ইসি গঠনে দেশবাসীর সামনে নাটক মঞ্চস্থ করছে।'

যদিও সার্চ কমিটির সঙ্গে বিশিষ্টজনের মতবিনিময়ের সময় বিএনপির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দেওয়া তালিকায় নতুন সিইসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কাজী হাবিবুল আউয়ালের নাম ছিল। পরে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালেও ডা. জাফরুল্লাহ বলেছিলেন, বিএনপি এ প্রক্রিয়ার বাইরে থাকলেও যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হলে তাদের মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। গতকাল শনিবার রাতে ডা. জাফরুল্লাহ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সরকার অনেক দিন পর সঠিক কাজ করেছে। তাদের অভিনন্দন। আশা করি, তাকে সব ধরনের সাপোর্ট দেওয়া হবে এবং তিনি তার দায়িত্ব পালন করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবেন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করছে, নতুন ইসি দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করবে। দলটির সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ সমকালকে বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন উপহার দিতে নতুন ইসিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে তার দল।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সার্চ কমিটির কাছে যে নাম প্রস্তাব করা হয়, তাতে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নাম ছিল ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) তালিকায়। দলটি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক ছিল। সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনের কারণে তারা জোট থেকে বেরিয়ে যায়। এনপিপির চেয়ারম্যান শেখ ছালাহউদ্দিন ছালু গতকাল সমকালকে জানান, হাবিবুল আউয়াল ও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ৪০ বছর ধরে পরিচিত হওয়ার সুবাদে তিনি তার দল থেকে এই নাম প্রস্তাব করেছিলেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নতুন ইসিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতেই সরকার নিজেদের লোক দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। ইসি গঠনে সরকার যে নাটক করেছে, তার শেষ ধাপ ছিল আজ। নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করেছে। সরকারের তালিকা অনুযায়ী লোকদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিয়েছে। রাষ্ট্রপতিও সরকারের দেওয়া পাঁচজনের তালিকা প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেন, নতুন কমিশনের সদস্যরা সবাই সরকারের পছন্দের, অনুগত, সুবিধাভোগী ও তোষামোদকারী। নতুন নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা এ সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন।

বিভিন্ন দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়া: সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, বৃক্ষের নাম গুরুত্বপূর্ণ নয়; ফল কেমন দেয়, সেটা দেখতে হবে। তিনি বলেন, নতুন সিইসি ছাড়া আর কাউকে তিনি চেনেন না। আগে তাদের সম্পর্কে জেনে-বুঝে আজ রোববার সংবাদ সম্মেলনে দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবেন।

নবনিযুক্ত কমিশনারদের শুভেচ্ছা জানিয়ে গতকাল এক বিবৃতি দিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার। এতে তারা দেশের সংবিধান ও আইনকে সমুন্নত এবং নির্বাচন কমিশনের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে কমিশনের ক্ষমতা ও এখতিয়ার বলিষ্ঠভাবে প্রয়োগ করে আগামীতে জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে সাফল্য অর্জন করবেন বলে আশা ব্যক্ত করেন।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ সমকালকে বলেন, অনেক কষ্ট করে, অনেক খুঁজে বের করা হয়েছে তাদের। রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের অভিনন্দন জানাই।

ড. তোফায়েল বলেন, 'আশা করব, জাতির প্রত্যাশা অনুসারে তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সব নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, সব ধরনের প্রভাবমুক্তভাবে সম্পন্ন করে তাদের ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবেন। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে তারা যেন সমর্থ হন। দৃঢ়ভাবে আশা করব, দেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করতে তারা তাদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখাবেন।'

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের কাউকেই তিনি ভালো চেনেন না। তাদের কারও সঙ্গে কোনো দিন তার সাক্ষাৎ হয়েছে বলে মনে পড়ে না। অতএব, তাদের সম্পর্কে কিছু বলা সমীচীন হবে না।

তিনি বলেন, সদ্য পাস হওয়া ইসি নিয়োগ আইনের ৪(১) ধারা অনুযায়ী সার্চ কমিটি স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিরপেক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে নাম সুপারিশ করবে। কিন্তু তারা তা করেননি। তাই আইনের এই ধারা লঙ্ঘিত হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

নতুন সিইসি পেয়েছেন নানা রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও আনুকূল্য: এবারের ইসি গঠন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই সিইসি পদে কে আসছেন, তা নিয়ে নানামুখী গুঞ্জন চলছিল। এই পদে ঘুরেফিরে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সাবেক বিচার বিভাগের কর্মকর্তার নাম। সার্চ কমিটির আমন্ত্রণে বৈঠকে অংশ নিয়ে বিশিষ্টজনও মত দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক সরকারের আমলে সুবিধা পাওয়া ব্যক্তিরা যাতে এসব পদে নিয়োগ না পান। চাকরিজীবনে কোনো বিতর্কে নেই- এমন লোকের নামই যেন সার্চ কমিটি সুপারিশ করে।

কিন্তু সিইসি পদে নিয়োগ পাওয়া কাজী হাবিবুল আউয়াল বর্তমান সরকারের সুবিধাভোগী এবং বিচার বিভাগের এই কর্মকর্তার সচিব হওয়া নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। সরকারি চাকরি থেকে বিদায় নেওয়ার পর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছিলেন তিনি।

২০১৭ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব পদ থেকে অবসরে যাওয়া এই কর্মকর্তা ১৯৮১ সালে মুন্সেফ (সহকারী জজ) হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেন। বিচার বিভাগের কর্মকর্তা হাবিবুল আউয়াল আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগে সুপারনিউমারারি (স্বল্প সময়ের জন্য) সচিব ছিলেন। সেখান থেকে তাকে রাষ্ট্রপতির ১০ শতাংশ কোটায় প্রথমে ধর্ম সচিব এবং পরে প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়।

তবে আইন সচিব হিসেবে তার নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে ২০১০ সালে রায় দেন আদালত। আইন সচিব থাকা অবস্থায় দুই বিচারককে অবসরে পাঠানো নিয়েও তিনি আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়েন। সংসদীয় কমিটি এ জন্য তাকে তলব করলে তিনি ওই ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে ক্ষমাও চান।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই তিনি একাধিকবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল তার। পরে পিআরএল বাতিল করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে এক বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে। ২০১৬ সালে চুক্তির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়। ২০১৭ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেই অবসরে যান তিনি।

তার বাবা কাজী আবদুল আউয়াল কারা বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যার সময় তিনি কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স) ছিলেন। পরে এই নৃশংস হত্যাকাে র বাদী হয়ে মামলা করেন কাজী আবদুল আউয়াল।

আরও পড়ুন

×