ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ডলার সংকটের নেপথ্যে ব্যাংক-মানিএক্সচেঞ্জ চক্র, বিমানবন্দরে দুদকের অভিযান

ডলার সংকটের নেপথ্যে ব্যাংক-মানিএক্সচেঞ্জ চক্র, বিমানবন্দরে দুদকের অভিযান

হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ফাইল ছবি

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ২১:৫৩

দেশে ডলার সংকটের নেপথ্যে অন্যতম ভূমিকা পালন করছে কতিপয় ব্যাংক ও মানিএক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের একটি সংঘবদ্ধ চক্র। হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের আনা প্রতিদিনের শত কোটি টাকার বেশি মূল্যের ডলারসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কুক্ষিগত করছে ওই চক্রটি। তারা বিদেশ থেকে আগতদের জাল ভাউচার দিয়ে ওইসব বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণ পরে সেগুলো খোলা বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে।

এ কারণে ওইসব বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে থাকছে না। একই কারণে মুদ্রাগুলো রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। গতকাল সোমবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি বিশেষ এনফোর্সমেন্ট টিম হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দরে অনভিযান চালিয়ে সিন্ডিকেট করে একটি চক্রের বৈদেশিক মুদ্রা গ্রাস করার প্রমাণ পেয়েছে। আজ মঙ্গলবার দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন এক ব্রিফিংয়ে বিমানবন্দরে ব্যাংক ও মানিএপচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের চক্র কর্তৃক বৈদেশিক মুদ্রা কুক্ষিগত করার তথ্য সাংবাদিকদের জানান।

দুদক সচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‌‘হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে প্রতিদিন বিদেশ থেকে আসা শত কোটি টাকার বেশি মূল্যের ডলারসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখায় এন্ট্রি করা হচ্ছে না। তাতে ওইসব মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে আসছে না। এই কারণে মুদ্রাগুলো রিজার্ভেও অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখা ও মানিএক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি চক্র যোগসাজশে বেআইনিভাবে ওই কাজ করছে। দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিমের সদস্যরা ব্যাংকের শাখাগুলো থেকে মুদ্রা বিনিময়ের ভুয়া ভাউচারসহ অন্যান্য নথিপত্র সংগ্রহ করেছে। অভিযোগটির বিস্তারিত অনুসন্ধান করে কমিশনে প্রতিবেদন পেশ করা হবে। পরে কমিশন প্রতিবেদন অনুযায়ি আইনি ব্যবস্থা নেবে।’

দুদক সচিব আরও বলেন, ‘বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে জনতা, সোনালী, অগ্রণী, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, পূবালী, প্রবাসী কল্যাণ ও যমুনা ব্যাংকের শাখাসহ কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান দেশে ডলার সংকটের নেপথ্যে ওইসব জাল-জালিয়াতি করছে। মানি এক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- এভিয়া মানি এক্সচেঞ্জার ও ইমপেরিয়াল মানি এক্সচেঞ্জারসহ অন্যান্য। দুদক নথিপত্র ঘেটে অনুসন্দান করে এই জালিয়াতির পেছনের হোতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনবে।’

সাংবাদিদের প্রশ্নের জবাবে দুদক সচিব মাহবুব হোসেন জানান, সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ আসে। তার ভিত্তিতে গোয়েন্দা কমিশনের ইউনিট অনুসন্ধান করে। অনুসন্ধানের তথ্যের ভিত্তিতে গত সোমবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট টিম বিমানবন্দরে অভিযান পরিচালনা করে। দেখা যায়, যারা বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রাসহ দেশে আসেন। তারা ডলার বা যেসব বৈদেশিক মুদ্রা আনেন সেগুলো ব্যাংকের মাধ্যমে ভাঙিয়ে টাকায় বিনিময় করেন। ওইসব ব্যাংকের শাখা বিদেশ থেকে আগতদের বৈদেশিক মুদ্রা ভাঙিয়ে টাকা ঠিকই প্রদান করেন। এ ক্ষেত্রে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকে এন্ট্রি করেন না। ব্যাংকগুলোর যেসব রেকর্ডপত্র পরীক্ষা করা হয়েছে তাতে দেখা যায়, প্রতিদিন শতাধিক কোটি টাকা মূল্যের বেশি বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন হয়ে থাকে। ওইসব মুদ্রা কারসাজি করে খোলা বাজারে দেওয়া হয়। এই কারসাজির বিমানবন্দরে ওইসব ব্যাংকের শাখাগুলো করছে নাকি তাদের কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে অবগত আছেন– এই প্রশ্নটি রয়েই যায়। যা অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে। পুরো বিষয়টি দুদকের নজরদারিতে আছে। আইন অনুযায়ী পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী বিদেশ থেকে আনা মুদ্রা বিনিময়ের সময় এন্ট্রি করার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো তা করছে না। ব্যাংকিং আইন লঙ্ঘন করে তারা আগত ব্যক্তিদের ভুয়া ভাউচার দিচ্ছেন।

সাধারণত প্রতিদিন হাজার হাজার প্রবাসী কর্মজীবী এবং বিদেশ থেকে বাংলাদেশে ভ্রমণকারীরা বিমানবন্দর হয়ে বাংলাদেশে আসেন। তারা তাদের সঙ্গে আনা বিদেশি মুদ্রা বিমানবন্দরে থাকা ব্যাংকের বুথ ও মানি এক্সচেঞ্জারে দেশি মুদ্রা/বাংলাদেশি টাকায় বিনিময় করে থাকেন। আইন অনুযায়ী, ফরেন কারেন্সি এনকেশমেন্ট ভাউচার এনকেশমেন্টকারীকে দিতে হয়। কিন্তু ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জাররা ভাউচার না দিয়ে বা জাল ভাউচার দিয়ে সরাসরি ফরেন কারেন্সি গ্রহণ করে তার বিনিময়ে টাকা দিয়ে দেন। এছাড়াও তারা স্বাক্ষরবিহীন, ভুয়া ভাউচার/এনকেশমেন্ট স্লিপ দিয়ে দেন। এই বিদেশি মুদ্রার ক্রেতা ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মূল হিসাবে/প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত একাউন্টে অন্তর্ভুক্ত  করেন না। ফলে বিদেশি মুদ্রার কেন্দ্রীয় রিজার্ভে এসব বিদেশি মুদ্রা যুক্ত হয় না, যার ফলে বাংলাদেশ বিদেশি মুদ্রার ঘাটতি বা সংকটের সৃস্টি হয়।

অপরাধে জড়িতরা অবৈধভাবে প্রতিদিন ডলার, ইউরো, রিয়াল, রিঙ্গিত, পাউন্ড, দিনার ও অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা কিনছেন। বিদেশি মুদ্রাপাচারকারী, বিদেশি মুদ্রার কালোবাজারি ও বাংলাদেশ থেকে বিদেশে মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচারকারী দুর্নীতিবাজদের অবৈধভাবে সরবরাহ করে। দুদকের অভিযানে এসব তথ্য মিলেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

আরও পড়ুন

×