হাজারীবাগের শামসুননেছা আরজু শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্র
চিকিৎসার আড়ালে ভয়ংকর যৌন নিপীড়ক ডা. আশরাফ

ডা. আশরাফ
তবিবুর রহমান
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৪ | ০১:০৭
রাজধানীর হাজারীবাগের বেড়িবাঁধে অবস্থিত ১০ শয্যার শামসুননেছা আরজু মনি মা ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ডা. আশরাফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে চিকিৎসকসহ বহু নারীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানি করা তাঁর নেশায় পরিণত হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটির পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন ডা. আশরাফ। এ পদের প্রভাব খাটিয়ে একাধিক নারী সহকর্মীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন তিনি। বিভিন্ন অজুহাতে কাছে ডেকে যৌন হয়রানি করেন তিনি। তবে চাকরি টিকিয়ে রাখা এবং সামাজিক লজ্জার ভয়ে দীর্ঘদিন মুখ বুজে এসব নির্যাতন সহ্য করেছেন ভুক্তভোগী নারীরা। যৌন হয়রানির শিকার একাধিক নারী এসব তথ্য জানিয়েছেন সমকালকে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ডা. আশরাফের যৌন হয়রানির শিকার হয়ে একাধিক নারী গত বছর নভেম্বরে ঢাকা বিভাগীয় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগ আমলে নিয়ে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। তবে অদৃশ্য কারণে তদন্ত করা হয়নি। পরে ভুক্তভোগীরা কেন্দ্রীয় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে অভিযোগ দিলে তা আমলে নিয়ে গত নভেম্বরে দ্বিতীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গত এপ্রিলে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ডা. আশরাফের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে কমিটি। তবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এখনও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, চিকিৎসকদের পাশাপাশি দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নারী কর্মচারীদেরও যৌন হয়রানি করেছেন ডা. আশরাফ। ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক মিডওয়াইফ লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন, ডা. আশরাফের সঙ্গে ওই হাসপাতালের এক পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকার অনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এক দিন তিনি তাদের ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেললে তাঁকেও অনৈতিক প্রস্তাব দেন ডা. আশরাফ। তিনি রাজি না হওয়ায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করেন। তাঁর বেতন চার মাস বন্ধ রাখেন।
শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক নারী অফিস সহায়ক কাম কম্পিউটার অপারেটর বলেন, যে কোনো প্রয়োজনে ডা. আশরাফের অফিস কক্ষে গেলেই কুপ্রস্তাব দিতেন। তিনি একাধিক নারীর প্রতি আসক্ত। তাঁর নির্যাতনে অনেক নারী এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বদলি হয়ে চলে গেছেন। তিনি বলেন, ‘আশরাফের পরিবারের উচিত তাঁকে মানসিক রোগের চিকিৎসা করানো।’
চিকিৎসাকেন্দ্রের একজন আয়া জানান, ছুটির আবেদন করতে গেলে এই কর্মকর্তার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসতে হতো। তিনি জোরপূর্বক শরীরে হাত দিতেন। চাকরি বাঁচানো এবং সম্মানের ভয়ে এসব বিষয় চাপা রেখেছিলেন তারা। এক পর্যায়ে নিরুপায় হয়ে অধিদপ্তরে লিখিত আবেদন করেছেন।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক শারীরিক প্রতিবন্ধী আয়াও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, ডা. আশরাফের বিরুদ্ধে জবানবন্দি দেওয়ার কারণে তাঁকে এই হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলি করা হয়। তিনি জীবননাশের হুমকি দিচ্ছেন। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে হাজারীবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ডা. আশরাফের বিরুদ্ধে ৮-১০ জন নারী যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. মুনীরুজ্জামান সিদ্দীকীকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। গত এপ্রিলে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিটি। তবে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি অধিদপ্তর। গত ৬ মে এসব ভুক্তভোগী নারী ফের যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) আসিব আহসানের কাছে যান। তবে তিনি তাদের অভিযোগ গ্রহণ করেননি বলে জানা গেছে।
তদন্তের বিষয়ে ডা. মুনীরুজ্জামান সিদ্দীকী বলেন, ‘আমাদের কাজ ছিল তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া। এক মাস আগে তা জমা দিয়েছি। বাকি কাজ দেখছে প্রশাসন। এর বাইরে আমার আর কিছু বলার নেই।’
অভিযোগ অস্বীকার করে ডা. আশরাফ সিদ্দিকী সমকালকে বলেন, ‘আমি ভালো কাজ করি বলে আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ। যৌন হয়রানির অভিযোগ ভিত্তিহীন। মানহানি করতেই এসব করা হচ্ছে। তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ মিললে অধিদপ্তর আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’
তবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়ায় সেই পরিদর্শিকাকে সাভারে বদলি করা হয়েছে। দ্রুত ডা. আশরাফের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসব অভিযোগ নিষ্পত্তির দায়িত্ব পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) আসিব আহসানের। তদন্তে প্রমাণ পেলেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না, তা জানতে গত এক মাসে ১০০ বারের বেশি ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। পাঁচ দিন তাঁর অফিসে গেলেও মিটিংয়ে আছেন বলে দেখা করেননি।
- বিষয় :
- যৌন নিপীড়ন