কলাবাগানে কালা ফিরোজের 'কালো অধ্যায়'

শফিকুল আলম ফিরোজ
সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০১৯ | ১৫:০০ | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৯ | ১৫:৩৫
কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগ নেতা পরিচয়ধারী শফিকুল আলম ফিরোজ ওরফে কালা ফিরোজ। ক্লাবে ক্যাসিনোর কারবার করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। তার ক্ষমতার হাত ছিল অনেক লম্বা। কলাবাগানে তার ইশারায় অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ হতো। নতুন বাড়ি ও ব্যবসা তৈরি করতে গেলেও নজর পড়ত তার বাহিনীর। ক্যাসিনো ছাড়াও নির্মাণাধীন বাড়ি থেকে চাঁদা তোলা ছিল তাদের আয়ের অন্যতম উৎস। এমনকি চাঁদা হিসেবে নতুন ফ্ল্যাটও দাবি করে বসতেন তারা। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে গভীর সখ্য ছিল তার। শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজিদুল ইসলাম ইমন ও তানভীরুল ইসলাম জয়ের 'ক্যাশিয়ার' ছিলেন তিনি। এ ছাড়া ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তার যুবলীগ দক্ষিণের সাবেক বহিস্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও ঠিকাদার মোগল জি কে শামীমের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা ছিল। ক্লাবের আড়ালে কালা ফিরোজ দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকায় অপরাধ সামাজ্যের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তার 'কালো অধ্যায়' নিয়ে ভয়ে মুখ খোলারও সাহস পেতেন না কেউ।
গত ২২ সেপ্টেম্বর অস্ত্র, গুলি, ইয়াবাসহ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন কালা ফিরোজ। এর পর তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা করা হয়। ওই মামলায় এরই মধ্যে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাকে।
র্যাব-২-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ সমকালকে বলেন, 'কালা ফিরোজের কাছ থেকে এরই মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশির দশক থেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়েন কালা ফিরোজ। প্রথমে ছিনতাই মামলায় জড়িয়ে সৌদি আরবে চলে যান তিনি। এরপর মধ্যপ্রাচ্যে লোক পাঠাতে শুরু করেন কিছুদিন। পরে তার সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও সুইডেন আসলামের পরিচয় হয়। এ ছাড়া ফ্রিডম পার্টির নেতা রাসুর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা ছিল তার। ২০০১ সালের দিকে কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি হন তিনি। এরপর তার ভাগ্যের চাকা আরও ঘুরতে থাকে। তার পর থেকে অদ্যাবধি তিনি ওই ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সন্তানদের কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের নেতা বানান তিনি।
জানা গেছে, ২০০৬ সালে পরীবাগের জনশক্তি রপ্তানি ও ট্রাভেলস এজেন্সি 'দ্য তুর্কি অ্যাসোসিয়েটস'-এ চাঁদা না দেওয়ায় এলোপাতাড়ি গুলি চালানো হয়। এতে একজন নিহত ও ছয়জন গুলিবিদ্ধ হন। এ ঘটনায় রমনা থানায় দায়ের করা হত্যা মামলার আসামি ছিলেন কালা ফিরোজ। মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছিল ফিরোজের ভাই শমসের আলম নসুকে। পরে জানা যায়, চাঁদাবাজি ও ব্যবসায়িক বিরোধের জের ধরে শীর্ষ সন্ত্রাসী জয়ের নির্দেশে কালা ফিরোজ ও তার সহযোগীরা ওই হামলা চালায়।
খোঁজ নিয়ে এও জানা গেছে, ক্যাসিনো, মাদক কারবার ছাড়াও মানব পাচার ও স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে কালা ফিরোজের বিরুদ্ধে। এ সময় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে সখ্য ছিল তার। তবে ক্ষমতার পালাবদলে নিজের রংও বদলে ফেলেন তিনি। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সহসভাপতিও হন তিনি। এ ছাড়া কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতার পদও বাগিয়ে নেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৫ (শাহরাস্তি-হাজীগঞ্জ) আসনে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পেতেও দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন। একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানের সঙ্গেও সখ্য ছিল তার। ২০০৫ সালে র্যাবের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন হান্নান। এরপর কিছুদিনের জন্য পলাতক ছিলেন কালা ফিরোজ। তবে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরকে ম্যানেজ করে আবার সামনে আসেন তিনি।
২০০০ সালে সন্ত্রাসী হুমায়ুন কবির ওরফে মুরগি মিলন আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে বের হলে তাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এ ঘটনায় পরে কলকাতা থেকে গ্রেপ্তার হন শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন। এরপর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ইমন তখন জানান, মুরগি মিলন একজন নেতার আশীর্বাদপুষ্ট ছিল। ওই নেতার প্রভাব কাজে লাগিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করত সে। পরে সেভেন স্টার বাহিনীসহ সন্ত্রাসীদের একাধিক গ্রুপ সিদ্ধান্ত নেয়, মুরগি মিলনকে সরিয়ে দিতে হবে। মুরগি মিলনকে হত্যা করতে অর্ধকোটি টাকা খরচ করার পরিকল্পনা করে তারা। মুরগি মিলনকে হত্যা করার ওই অর্থ সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে গ্রহণ করেন কালা ফিরোজ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, কলাবাগান ক্রীড়া চক্রে ক্যাসিনো কারবার ছাড়াও ইয়াবার ব্যবসা করতেন কালা ফিরোজ। 'বিশেষ' ধরনের ইয়াবা ওই ক্লাবে পাওয়া যেত। অভিযোগ আছে, ঢাকার অন্যান্য ক্লাবেও ইয়াবা-বাণিজ্যে ফিরোজের হাত ছিল।
অভিযোগ রয়েছে, ফিরোজের তত্ত্বাবধায়নে বিভিন্ন জালিয়াত চক্র ধানমন্ডি, কলাবাগান ও রাজাবাজার এলাকায় জমির কাগজপত্র জালিয়াতি করে অবৈধ দখল ও হয়রানি করে আসছে। হুমকি-ধমকিতে কাজ না হলে তারা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামও ভাঙাত।
বছরতিনেক আগে কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সেক্রেটারি নাজমুল হাসান খাদ্যে বিষক্রিয়ায় রহস্যজনকভাবে মারা যান। তখন অভিযোগ উঠেছিল, ওই মৃত্যুর পেছনে কালা ফিরোজের হাত ছিল।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, কালা ফিরোজের অপরাধ-সাম্রাজ্যের আরও কয়েকজন সহযোগীর নাম পাওয়া গেছে। তাদের ব্যাপারে তথ্য নেওয়া শুরু হয়েছে। যে কোনো দিন আইনের আওতায় আনা হতে পারে তাদের।
কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা সমকালকে বলেন, 'শফিকুল আলম ফিরোজ ওরফে কালা ফিরোজ নামে কৃষক লীগের কোনো পদে এ নামের সদস্য নেই। শফিক কৃষক লীগের নেতা বা সদস্য ছিলেন, এটা কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। এই চ্যালেঞ্জ নিলাম। তবে কেউ যদি ভুয়া নেতা হিসেবে পরিচয় দিতে থাকে, সেটা অন্য বিষয়। গ্রেপ্তারের পর ছড়িয়ে পড়ে শফিক কৃষক লীগ নেতা। এতে কৃষক লীগের অনেক ক্ষতি হয়েছে।'