ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

কাজ হয়নি, বর্ষায় ডুবতে পারে ঢাকা

কাজ হয়নি, বর্ষায় ডুবতে পারে ঢাকা

.সামান্য বৃষ্টিতেই রাজধানীতে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। ফাইল ছবি: সমকাল

অমিতোষ পাল

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫ | ০১:৩৬ | আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৫ | ১০:০৪

বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে রাজধানীর জলাবদ্ধতা ঠেকাতে বেশ কিছু সংস্কার কাজ করে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে অস্থিরতা থাকায় এবার এর কিছুই হয়নি। দুই মাস ধরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) উন্নয়নমূলক সব কার্যক্রম বন্ধ। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) লেজেগোবরে অবস্থা। জনপ্রতিনিধি না থাকায় তাগিদ দেওয়ারও কেউ নেই।

এ কারণে খাল, বক্স কালভার্ট ও উন্মুক্ত ড্রেনের আবর্জনা পরিষ্কারের উদ্যোগ এবার তেমন চোখে পড়েনি। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। ভরা বর্ষায় ভারী বৃষ্টি হলে অবস্থার আরও অবনতির হতে পারে। 

আবহাওয়া অফিস বলছে, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীসহ সারাদেশে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। এক দিনে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি ছাড়িয়ে যেতে পারে। এতে রাজধানীজুড়ে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে পরিস্থিতি আরও নাজুক হতে পারে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল, নর্দমার বড় উন্নয়ন প্রয়োজন। সঙ্গে রুটিন কাজও চালু রাখতে হবে।

দুই সিটিতেই সংকট
খাল ও ড্রেনেজ সার্কেল ঢাকা ওয়াসা থেকে দুই সিটি করপোরেশনের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলেও এ কাজে কোনো জনবল নেই। সিটি করপোরেশনে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাও নেই। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে সেবা সংস্থাগুলোতে এমনিতেই কার্যক্রম স্থবির। তার ওপর বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবি ঘিরে দুই মাস ধরে অচল ডিএসসিসির কার্যক্রম। আর ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের সঙ্গে শুরু থেকেই রয়েছে কর্মকর্তাদের দূরত্ব। যে কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে নেওয়ায় এ মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্‌রীরের সঙ্গে মোহাম্মদ এজাজের সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগে তাঁর 

পদত্যাগ দাবি করে ভিপি নুরুল হক নুরুর দল গণঅধিকার পরিষদ। এর পর সপ্তাহখানেক প্রশাসককে নগরভবনেই দেখা যায়নি। এ ছাড়া সংস্থার বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যেই রয়েছে গা-ছাড়া ভাব।  

উদ্যোগের অগ্রগতি নেই
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান সরকার রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে কালুনগর, হাজারীবাগ, শ্যামপুর ও জিরানি খালের যে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল, তার কোনো অগ্রগতি নেই। এই চার খালের যে ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) তৈরি করা হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করতে হলে খালপাড়ের দুই হাজার অবকাঠামো সরিয়ে ফেলতে হবে, যা বাস্তবে অসম্ভব। এ জন্য চলছে নতুন করে ডিপিপি প্রণয়নের কাজ। 

এদিকে ধোলাইখাল, মানিকনগর, হাতিরঝিল, কল্যাণপুর ও মিরপুর চটবাড়ি পাম্পস্টেশনের পানি নিষ্কাশনের অর্ধেক পাম্পই নষ্ট। বক্স কালভার্টও এবার যথাসময়ে পরিষ্কার করা হয়নি। খালগুলোতেও চলেনি পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম। 

কল্যাণপুরের পীরেরবাগ কালভার্ট পয়েন্টে সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৩০ ফুট প্রশস্ত খালের মাত্র ২-৩ ফুট অংশ দিয়ে কোনো রকমে ময়লা পানি যাচ্ছে। খালজুড়ে আবর্জনার স্তূপ। বর্জ্য অপসারণ না করায় অন্য সব খালের প্রায় একই হাল। দুই সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কাজ স্থবির থাকায় উন্মুক্ত ড্রেনগুলোও এবার পরিষ্কার করা হয়নি। অথচ ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে রাজধানীতে। উন্মুক্ত ড্রেনগুলো দিয়েই পানি বক্স কালভার্টে ঢোকে। পরে তা খাল বা নদীতে চলে যায়। খাল, উন্মুক্ত ড্রেন, পাইপ ড্রেন ও বক্স কালভার্টের বেশির ভাগ এখনও আবর্জনায় পূর্ণ। নিউমার্কেট এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে নায়েম থেকে পিলখানা পর্যন্ত একটি বড় পাইপ ড্রেন করার কাজও বাস্তবায়ন করা হয়নি। 

যেসব স্থানে জলাবদ্ধতার শঙ্কা
জলাবদ্ধতার হটস্পট চিহ্নিত হলেও এর সমাধানে কার্যকর কিছুই করতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন। ডিএসসিসির ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার তালিকায় রয়েছে নিউমার্কেট, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, ঢাকা কলেজ এলাকা, নায়েম সড়ক, বকশীবাজার মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, জুরাইন আলমবাগ ও ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের মিতালী স্কুল রোড। এ ছাড়া রাজারবাগ গ্রিনলাইন বাস কাউন্টারের সামনের সড়ক, মুগদা প্রধান সড়ক ও মুগদা হাসপাতালের আশপাশ এলাকা। 

ডিএনসিসির ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার তালিকায় রয়েছে বাড্ডা, ভাটারা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, হরিরামপুর, মিরপুর, বিমানবন্দর সড়কসহ পুরো এলাকা। এর মধ্যে বিমানবন্দর সড়ক জলাবদ্ধতায় বেশি ভোগাতে পারে। ওই সড়কে ড্রেনেজ লাইনই নেই। 

একবার সিটি করপোরেশন সড়ক ও জনপথ বিভাগকে ড্রেনেজ তৈরির সার্বিক পরিকল্পনা তৈরি করে দিলেও তারা ওই সড়কে ড্রেনেজ লাইন তৈরি করতে করেনি। এবার ভারী বর্ষায় সড়কটির তলিয়ে থাকার শঙ্কাই বেশি। 

এ ছাড়া বনানী কবরস্থান সড়কের পাশে একটি জলাধার ছিল। সেটি ভরাট করায় ওই সড়কের পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয়। এ কারণে প্রতিবছর বর্ষা এলেই সেখানে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। রোকেয়া সরণির ড্রেনেজ সংস্কারকাজ কিছুটা এগোলেও ভারী বর্ষণে ওই সড়ক জলাবদ্ধতা থেকে নিস্তার পাচ্ছে না। 

নগর পরিকল্পনাবিদের ভাষ্য
এ পরিস্থিতিতে ভারী বৃষ্টি হলে অবস্থা বেগতিক হতে পারে বলে মত দিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল-নর্দমা পরিষ্কার রাখতে হবে। সচল রাখতে হবে পানি নিষ্কাশন নেটওয়ার্ক। এবার কোনো কাজই হচ্ছে না। 

তিনি জানান, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশন খাল ও নর্দমার দায়িত্ব বুঝে নিলেও তারা স্বতন্ত্র বিভাগ বা সার্কেল গড়ে তুলতে পারেনি। প্রস্তাবিত সার্কেল করে কাজ করলেও সেখানে ড্রেনেজ বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক নেই। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমেও স্থবিরতা চলছে। কাজেই ভারী বৃষ্টি হলে অবস্থা কী হতে পারে, সহজেই বোঝা যাচ্ছে। 

কর্তৃপক্ষ যা বলছে
এ ব্যাপারে ডিএসসিসির জলাবদ্ধতা নিরসন কাজ সমন্বয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের সমকালকে বলেন, আগে ওয়াসা ৩০০ জনবল দিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করত। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেল সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করলেও তাদের জনবল সিটি করপোরেশনে যুক্ত হয়নি। এ জনবল নিয়োগ দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এখন তা টেবিলে টেবিলে ঘুরছে। 

ডিএনসিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফারুক হাসান আল মাসুদ সমকালকে বলেন, যতদিন খালগুলো ঠিক না হবে, ততদিন বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হবেই। সম্প্রতি কয়েকটি ভারী বর্ষণেও রাজধানীতে জলাবদ্ধতা হয়েছে। যেসব স্থানে জলাবদ্ধতা তৈরি হতে পারে, সেটা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা চলছে।

আরও পড়ুন

×