আবার চালু হচ্ছে পিপলস লিজিং?

ওবায়দুল্লাহ রনি
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১৫:০৫
আদালতের আদেশে অবসায়ন প্রক্রিয়ায় থাকা সমস্যাগ্রস্ত পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (পিএলএফএস) আবার চালুর প্রস্তাব এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় এসে চালু করতে আবাসন খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি এবং শামসুল আলামিন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর শামসুল আলামিনসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী আগ্রহ দেখিয়েছেন। আলমগীর শামসুল আলামিনের পরিবারের কয়েকজন সদস্য এক সময় পিএলএফএসের মালিকানায় ছিলেন। তারা পরিচালনা পর্ষদেও ছিলেন।
পিপলস লিজিং অবসায়ন প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিব উল আলমের মতামত নিয়ে তা পাঠানো হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে। বিশিষ্ট এ আইনজীবী আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি চালুর পক্ষে মত দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, পিপলস লিজিং বন্ধ না করে চালুর জন্য সম্প্রতি আলমগীর শামসুল আলামিনসহ কয়েকজন অর্থ মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেন। এই আবেদনের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনি মতামত চায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যারিস্টার তানজিব উল আলমের আইনি মতামত নিয়ে পরবর্তী প্রক্রিয়ার জন্য গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠিয়েছে। তানজিব উল আলম পিপলস লিজিং অবসায়ন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন।
মতামত জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম পিপলস লিজিংয়ের বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি সমকালকে বলেন, মূল্য সংবেদনশীল এবং গোপনীয় বিষয় হওয়ায় এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না। আইনি ব্যাখ্যা জানতে চাইলে বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান অবসায়ন প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার বিধান আইনে আছে। এমনকি অবসায়নের চূড়ান্ত আদেশ হওয়ার পরও আদালত চাইলে আবার চালুর সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে সমকালকে বলেন, দেশে এর আগে কোনো প্রতিষ্ঠান অবসায়ন হয়নি। একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রক্রিয়ার কারণে পুরো খাতের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভালো কৌশল নিয়ে পিপলস লিজিং চালু করা গেলে সে ক্ষেত্রেও কিছুটা উন্নতি হবে। অবসায়ন প্রক্রিয়ার অবস্থান থেকে সরে এসে প্রতিষ্ঠানটি আবার চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি কার্যকর হলে কী প্রক্রিয়ায় আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে এবং চাকরি হারানোদের কী হবে তা পরবর্তী সময়ে নির্ধারিত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শনে উঠে আসে, পিপলস লিজিং থেকে বিতরণ করা ঋণের অধিকাংশই জালিয়াতি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণ নেন দেশ থেকে পলাতক রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার বা পি কে হালদার এবং তার সহযোগীরা। পিপলস লিজিংসহ চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে এই চক্র সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পি কে হালদার মালিকানা নেওয়ার আগে ভুয়া কাগজ তৈরি করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় পিপলসের ৫ পরিচালককে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অপসারিতদের মধ্যে সাবেক চেয়ারম্যান মতিউর রহমান ১১৬ কোটি টাকা, সাবেক পরিচালক খবির উদ্দিন মিয়া ১০৭ কোটি টাকা এবং আরেফিন শামসুল আলামিন, নার্গিস আলামিন ও হুমায়রা আলামিন ২৯৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন মর্মে তখন দুদকে প্রতিবেদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আরেফিন শামসুল আলামিন, নার্গিস আলামিন ও হুমায়রা আলামিন- এই তিনজন রিহ্যাব সভাপতি শামসুল আলামিনের পরিবারের সদস্য। এসব ব্যক্তিসহ ১১ জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ ও সম্পত্তি হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। বাকিরা হলেন- পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাউথ বাংলা ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম হোসেন, সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ ইসমাইল ও বিশ্বজিৎ কুমার রায়, সাবেক কর্মকর্তা কবির মোস্তাক আহমেদ, নৃপেন্দ্র চন্দ্র পণ্ডিত ও মো. শহিদুল হক। পরবর্তী সময়ে পি কে হালদারসহ আরও কয়েকজনের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়। পারিবারিক কারণে বারবার নাম এলেও রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন সরাসরি কখনও পিপলস লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন না।
জানতে চাইলে আলমগীর শামসুল আলামিন সমকালকে বলেন, পিপলস লিজিং এক সময় ভালো প্রতিষ্ঠান ছিল। তার পরিবারের লোকজন যখন ছিল প্রতিষ্ঠানটি ভালো চলছিল। পি কে হালদার দলবল নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি লুটেপুটে খেয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এ অবস্থা পুরো আর্থিক খাতের জন্য খারাপ। পিপলস লিজিংয়ের এ অবস্থা পুরো আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতকে আস্থাহীনতায় ফেলেছে। পুনরায় চালু করা গেলে এর প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। তিনি বলেন, সার্বিক বিবেচনায় তারা প্রতিষ্ঠানটি চালুর জন্য আবেদন করেছেন। ইতিবাচক সাড়া পেলে পরবর্তী উদ্যোগ কার্যক্রম শুরু করবেন। অর্থ মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ঋণগ্রহীতা ও আমানতকারী সবার সহযোগিতা নিয়ে ভালোভাবে চালাতে পারবেন বলে তিনি আশা করেন।
রুগ্ণ হয়ে যাওয়ায় আমানতকারীদের জমানো টাকা মেয়াদপূর্তির পর ফেরত দিতে না পারায় গত বছর পিপলস লিজিং বন্ধের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আবেদন করলে গত বছরের ১৪ জুলাই তা গ্রহণ করেন উচ্চ আদালত। এ প্রক্রিয়া শুরুর আগ থেকেই পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ উত্তোলন না করতে পেরে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করে আসছিলেন আমানতকারীরা। পিপলসের আমানতকারীরা জমানো টাকা ফেরত চেয়ে বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি দিয়ে আসছেন। তবে অর্থ ফেরত পাননি কেউ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ে আমানতকারীদের জমা আছে ২ হাজার ৩৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ের আমানত রয়েছে সাড়ে ৭শ' কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা ঋণের বড় অংশই নানা অনিয়মের মাধ্যমে বের হয়ে যাওয়া। এসব অর্থ ফেরত আসার তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নানাভাবে যারা এখান থেকে অর্থ নিয়েছেন তাদের অনেকেই এখন পলাতক। ফলে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যে কারণে এখন প্রতিষ্ঠানটি চালুর মাধ্যমে অর্থ ফেরতের বিকল্প ভাবা হচ্ছে। তবে কী উপায়ে কতদিনের মধ্যে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে এবং বাদপড়া কর্মীদের কী হবে আলোচনার ভিত্তিতে তা ঠিক হবে।
আদালতের নির্দেশনার আলোকে বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিএম আসাদুজ্জামান খান পিপলস লিজিংয়ের প্রতিষ্ঠানের সাময়িক অবসায়ক হিসেবে কাজ করছেন। আর সাবেক কর্মীদের মধ্য থেকে ২০ জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে মাত্র ১৬ কোটি টাকা।