ঘনীভূত সংকট ও সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ
নির্বাচন

এম এম আকাশ
এম এম আকাশ
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ | ১৭:০৬ | আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৩ | ১২:৫৭
বাংলাদেশের রাজনৈতিক যুদ্ধে জয়-পরাজয়টা বর্তমানে জীবন-মরণ সমস্যা এবং বৈরিতামূলক গোত্রীয় দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে দুটি দলের জন্যই। এ ক্ষেত্রে তাই সহজে কোনো মীমাংসা হবে না। এই দ্বন্দ্বটা আওয়ামী লীগের জন্য অনেকটা শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রাখার দ্বন্দ্ব। অন্যদিকে বিএনপির কাছে এই দ্বন্দ্বটা ক্ষমতায় আসার দ্বন্দ্ব। শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে দলকে সতর্ক করে দিয়ে প্রকাশ্যে বলেছেন, এবার যদি আমরা ক্ষমতায় যেতে না পারি তাহলে আমাদের চামড়া থাকবে না। অর্থাৎ এখানে তিনি নিজের এবং দলের বেঁচে থাকার প্রশ্ন সামনে এনেছেন। বিএনপি মনে করছে, তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে আছে। তারা যদি এখন ক্ষমতায় যেতে না পারে তাহলে দলকে আর ধরে রাখাই ভবিষ্যতে সম্ভব হবে না।
তবে আগামী নির্বাচন বিএনপি ঠেকিয়ে দিতে পারবে কিনা, সেটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দুই দলই যে কোনো সময় লক্ষাধিক লোক জড়ো করতে পারে। কিন্তু দুই দলের কেউই নিজের সমর্থনে গণঅভ্যুত্থান বা গণজোয়ার সৃষ্টি করতে পারে না। যেমন বিএনপি তাদের সর্বশেষ বৃহৎ কর্মসূচিতে ঢাকায় মহাসমাবেশে অনেক লোক জমায়েত করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা দেখেছি, তা পণ্ড করতে রাষ্ট্রের কোনো অসুবিধা হয়নি! এখন নতুন করে বিএনপিকে আবার আন্দোলনের পালে হাওয়া জোগাড় করতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র চায়। কিন্তু তাদের নেতৃত্ব দিয়ে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করার মতো কোনো দল মাঠে নেই।
আবার আওয়ামী লীগ যে অনেক উন্নয়ন করেছে এবং মানুষ তাদের দলে দলে আবার ভোট দিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে বলে দাবি করে, সেটা কি ঠিক? আমার মনে হয়, সেটা ঠিক না। কারণ বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। সার্বিকভাবে দেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা হয়তো কমেছে। এর পরও দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ ধরলেও ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে তিন কোটির বেশি দরিদ্র। তিন কোটি মানুষের অসন্তুষ্টি কম বড় বিষয় নয়। জনগণ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে যারা চুরি করছে, বাটপারি করছে, যারা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে সেটাও শোধ করছে না, যারা অবৈধভাবে টাকা বানাচ্ছে এবং তা পাচার করছে, যারা সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে– শাসক দলের আনুকূল্যপ্রাপ্তরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানেও সেটা প্রতিফলিত। সর্বশেষ ২০১৬ সালে যখন আয়বৈষম্য পরিমাপ করা হয় তখনও দেখা গেছে, ধনী-গরিবের মধ্যে আয়বৈষম্য শূন্য দশমিক ৫০-এর কাছাকাছি। বিশ্বের অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আয়বৈষম্য শূন্য দশমিক ৫০-এর ঘরে যাওয়া মানে সেটা বিপৎসীমা অতিক্রম করা। সর্বশেষ একটি জরিপে জানা যায়, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করে, ‘অর্থনীতি ভুল পথে চলছে’ (দৈনিক প্রথম আলো, ৩০ আগস্ট)।
কেউ কেউ বলেন, শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অনুগত লোকদের দিয়ে এই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। অনেকেই বলেন, এটা করতে গিয়ে তিনি মেরিটোক্রেসিকে গুরুত্ব না দিয়ে সিভিল সোসাইটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। সুতরাং আমরা এটুকু বলতে পারি, এমন কোনো শক্তিশালী ইতিবাচক অভ্যন্তরীণ শক্তি এখনও দেখা যাচ্ছে না, যেটা শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারে। কিন্তু বহিঃশক্তির দিক থেকে একটি চাপ রয়েছে। আগামী নির্বাচন ভালোভাবে করার জন্য চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি একটি শক্তিশালী ফ্যাক্টর বটে। কারণ আমাদের উদীয়মান পোশাকশিল্প, সেনাসদস্যদের বিদেশি মিশনে যোগদান এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ থেকে ডলার প্রাপ্তি, সিভিল সোসাইটির সমর্থন– এ সবকিছুতেই আমেরিকার লিভারেজ বা প্রভাব রয়েছে। ফলে সেটা ব্যবহার করে ‘ভালো নির্বাচন’-এর জন্য তারা যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে নির্বাচন ভালোভাবে করার অর্থ কী?
বিএনপি নির্বাচন ভালোভাবে করার অর্থ করেছে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন। বামপন্থিরাও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে না। তারাও মনে করছে, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সরকার তার প্রশাসন, অর্থ ও পেশিশক্তি ব্যবহার করে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে দেবে না। বর্তমানে স্থানীয় নির্বাচনসহ যত ধরনের নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে ভোট দেওয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহে তারতম্য দেখা যাচ্ছে। ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি সাধারণভাবে কমছে। ভোটারের উপস্থিতি যত কম হবে আওয়ামী লীগের জন্য ততই ভালো। আওয়ামী লীগ হস্তক্ষেপশূন্য নির্বাচন দিয়েও জিততে পারবে। আওয়ামী লীগ চাইতে পারে– বিএনপি এবার ভোট বয়কট করুক, কিন্তু তাদের নিজস্ব লোক ও দল ভোটে আসুক। এ ধরনের একতরফা নির্বাচনে বিএনপি ভোট বয়কট করলে সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে বলে দাবি করতে পারে। নিরপেক্ষ নির্বাচন এই অর্থে যে, এবার আগে থেকে ব্যালট বাক্স ভরা হবে না; কোনো বল প্রয়োগও করা হবে না; প্রতিটা আসনে যে দাঁড়াতে চায় দাঁড়াবে। এমনকি আওয়ামী লীগের নিজ দল থেকে একটি আসনে যদি তিনজনও দাঁড়ায়, তাতেও তারা আপত্তি করবে না। কারণ এই তিনজনের মধ্যে যে-ই জিতুক, সে তো আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন বয়কটের নির্বাচন কি নির্বাচন বলে আদৌ গণ্য হবে? মনে হয় না তা হবে।
সরকার তৃণমূল বিএনপি নামের দলকে সামনে এনে প্রতিটি আসনে তাদের একজন প্রার্থী দাঁড় করাতে পারে। ধরা যাক এভাবে একটি কৃত্রিম প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করল। এখন প্রশ্ন– এ ধরনের কৃত্রিম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে তখন কোনো ধরনের গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনা দেখা দেবে কিনা। অথবা অভ্যন্তরীণ কোনো তৃতীয় শক্তি সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের প্রশাসনিক শক্তিকে নড়বড়ে করে দেবে কিনা। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভারত, আমেরিকা, চীন এসব বহিঃশক্তি আমাদের ওপর এ ক্ষেত্রে অনেক ক্ষমতা রাখে। আমেরিকা স্যাংশন আরোপ করলে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং জনগণের রাস্তায় নামা ছাড়া আর কোনো উপায় না থাকলে বা সে রকম পরিস্থিতি ঘটলে হয়তো ভিন্ন কিছু ঘটতে পারে। তবে সে ধরনের কোনো কিছু করার আগে আমেরিকা চিন্তা করবে এখানে তাদের লাভ কী। আমেরিকা বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বা গণতন্ত্র চায়; সেটাতে তাদের খুব বেশি আগ্রহ আছে বলে আমার মনে হয় না। পৃথিবীর অনেক জায়গাতে এ রকম গণতন্ত্রহীনতা চলছে, যেটাকে আলী রিয়াজ বলেন ‘কর্তৃত্বপরায়ণ গণতন্ত্র’। তাদের সঙ্গে আমেরিকা ভালো সম্পর্কও রেখে চলেছে। আমেরিকা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে পারলে বাংলাদেশের জনগণ বা গণতন্ত্র নিয়ে তাদের খুব বেশি মাথাব্যথা থাকবে বলে মনে হয় না।
২০১৮ সালের নির্বাচন খারাপ হলেও চীন ও ভারত সর্বপ্রথম সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তেমনি এবারও যদি একটি একদলীয় নির্বাচন হয়, যদি অন্য দলগুলো নির্বাচন বয়কট করে এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিজেকে বিজয়ী দেখায়, তবে ভারত, চীন ও রাশিয়া সরকারকে পুনরায় স্বীকৃতি দিতে পারে বলে মনে হয়। তবে সেই ধরনের একপক্ষীয় নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সাধারণভাবে প্রহসন বলেই বিবেচিত হবে। সুতরাং ভবিষ্যতে কী হবে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
যদি নাটকীয় কিছু ঘটে যায়, সেটা ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার এ দুই বিপরীত শক্তির মধ্যে হয়তো সীমাবদ্ধ থাকবে না। তখন হয়তো একটি তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটতে পারে। সেই দূরবর্তী সম্ভাবনার মাপকাঠিতে সত্যিই বাংলাদেশ আজ এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মার্কটাইম করছে।
অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক