করোনা সুরক্ষা সামগ্রী
উচ্চ দাম নিম্ন মান!

সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২০ | ১২:০০
আমাদের দেশে কোনো পণ্যের মান নিশ্চিতকরণ এবং একই সঙ্গে সংকটে সুযোগসন্ধানী চক্রের অতি মুনাফা লোটার ফায়দা আঁটার ফন্দি ঠেকানো উভয়ই কঠিন। 'দাম লাগামহীন, মানেরও নেই ঠিক-ঠিকানা'- শিরোনামে রোববার সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ফের যেন এর সত্যতা মিলেছে। দেশে করোনা সংক্রমণের হার এখনও ঊর্ধ্বমুখী। সংক্রমণ ক্রমবর্ধমান হওয়ায় মাস্ক, অক্সিমিটার, ভেন্টিলেটর, ফেসশিল্ড, স্যানিটাইজার, পিপিই, হ্যান্ড গ্লাভসসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর দাম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। মানের বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সঙ্গতই আমরা উদ্বিগ্ন। করোনার মতো প্রাণঘাতী সংক্রমণ ব্যাধির কোনো প্রতিষেধক এখনও পর্যন্ত আবিস্কৃত না হওয়ায় প্রতিরোধই যখন উত্তম পন্থা, তখন ভাইরাস প্রতিরোধ কিংবা সুরক্ষা সামগ্রী যদি হয় নিম্নমানের, তাহলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়বে- এটিই স্বাভাবিক। আমরা জানি, নিকট অতীতে কোনো কোনো কোম্পানির উৎপাদিত সুরক্ষা সামগ্রীর মান নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরও উৎপাদক শ্রেণির অনেকেরই অসাধু উপায়ে অতিরিক্ত মুনাফা লোটার প্রবণতা বন্ধ হয়নি!
আমরা জানি, আমাদের দেশে যে কোনো পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়িয়ে দেওয়ার পেছনে নানা রকম অজুহাত দাঁড় করানো হয়। এ ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। আরও বিপজ্জনক সংবাদ হলো- হাসপাতালে ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া গ্লাভস-মাস্কসহ অন্যান্য সামগ্রী একটি সংঘবদ্ধ চক্র সংগ্রহের পর রিসাইকেল করে পুনরায় বিক্রি করছে! আমরা মনে করি, নিরবচ্ছিন্ন আইনি নজরদারির অভাবে লোভাতুররা এমন সর্বনাশা কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের সমাজে জীবন নিয়ে জুয়া খেলার মতো বহুরকম ধ্বংসাত্মক কাণ্ডকীর্তির দৃষ্টান্ত অনেক আছে। করোনাদুর্যোগে যেখানে মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, সেখানে ব্যবসার নামে দুর্বৃত্তপনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। অভিযোগ আছে, কোনো কোনো নামিদামি কোম্পানিও নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী লাগামহীন দামে বিক্রি করছে। নিকট অতীতে এমনই একটি কোম্পানি অনলাইনে কয়েকগুণ বেশি দামে মাস্ক বিক্রি করায় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের আর্থিক দণ্ড করে।
যে বা যারা মহাদুর্যোগে মানুষের প্রয়োজন ও অসহায়ত্বকে পুঁজি করে এভাবে নিজেদের পকেট স্ম্ফীত করছে ও জনস্বাস্থ্যকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে, তারা মানুষের বন্ধু হতে পারে না। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে কারোর প্রতি কোনো অনুকম্পা প্রদর্শনের অবকাশ নেই। আমরা জানি, পিপিই তৈরির আগে দায়িত্বশীল দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে মান সনদ দেওয়ার জন্য সরকার বলেছিল। কিন্তু অভিযোগ আছে, অনেক উৎপাদকই এর ধার ধারছেন না। জীবন রক্ষা সামগ্রী নিয়ে চলমান তুঘলকি কাণ্ড বন্ধে সরকারের দায়িত্বশীলদের অধিকতর সজাগ থাকার পাশাপাশি মানহীন সুরক্ষা সামগ্রী ও উচ্চ দামে এসব বিক্রির বিরুদ্ধে অভিযান চালাতেই হবে।
অভিযোগ আছে, ইতোমধ্যে ওষুধের দামও কয়েকটি চক্র বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালে যেসব ওষুধ চিকিৎসকরা সেবনের পরামর্শ দিচ্ছেন, কয়েকগুণ দাম বেড়েছে সেগুলোর। অভিযোগ খতিয়ে দেখে সত্যাসত্য নির্ণয়ক্রমে উৎপাদক থেকে বিক্রেতা পর্যন্ত সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনার জোরদার উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে করোনা সুরক্ষা সামগ্রীর মান নিশ্চিতকরণসহ ন্যায্য দামে বিক্রির বিষয়ে অধিকতর মনোযোগ বাড়াতে হবে। হাসপাতালের বর্জ্য ধ্বংস করার কার্যক্রম আরও জোরদার করা দরকার। আমরা এও জানি, মেডিকেল বর্জ্য বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার অর্থায়নে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠানের ডেমরায় স্যানিটারি ল্যান্ডফিলে ডাম্পিং করার কথা। কিন্তু অভিযোগ আছে, এসব বর্জ্য সেখানে যায় না; অসাধু চক্রের সহযোগিতায় অনেক বর্জ্য বাইরে চলে যায় এবং সেখান থেকে ব্যবহূত উপকরণ সামগ্রী সংগ্রহ করে একটি চক্র বিক্রি করে আরেকটি চক্রের কাছে। অনেক হাসপাতালের গেটেই বিক্রি হচ্ছে মানহীন সুরক্ষা সামগ্রী। আমরা মনে করি, যাদের কাছে করোনাদুর্যোগ এভাবে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে, এসব মানবতার শত্রুদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করতেই হবে।
সুরক্ষা সরঞ্জামেই যদি থাকে অরক্ষার বীজ, তাহলে বিপদাশঙ্কা আরও প্রকট হবে। এমনটি কাম্য হতে পারে না। সুরক্ষা সামগ্রী যদি নিম্নমানের হয়, তাহলে করোনা প্রতিরোধ দুরূহ। ইতোমধ্যে হয়তো অনেকে এসব সামগ্রী ব্যবহারের ফলে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে। এমন বাস্তবতায় শক্তিশালী এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অবকাশ কতটা আছে? সুরক্ষা সামগ্রীর দাম নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড বন্ধের পাশাপাশি সুরক্ষা সরঞ্জামে অরক্ষার বীজ বপনের পথ রুদ্ধ করতেই হবে।