সমকালীন প্রসঙ্গ
স্প্যানিশ ফ্লুর অভিজ্ঞতায় কভিড-১৯ মোকাবিলা

ননী গোপাল দেবনাথ
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১২:০০
কভিড-১৯ মহামারি নিয়ে যখন ইতিহাসবিদরা লিখবেন, সেদিন সামান্যই উল্লেখ হবে মানুষের করোনা সংকটকালে ঘরে অন্তরীণ থেকে কেমন করে সময় কেটেছে। স্তূপীকৃত গ্রন্থে হয়তো থাকবে করোনাদিন উত্তীর্ণ নানা বিশ্নেষণের কথা, তবে বৈশ্বিকভাবে বিভিন্ন দেশে কত প্রাণের কীভাবে প্রয়াণ ঘটেছে, তার পরিসংখ্যান অবশ্যই থাকবে। যেমনটা আজ আমরা ১৯১৮ সালে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী স্প্যানিশ ফ্লু্লর ইতিহাস পড়ে জানতে পারি সেদিনকার মহামারি বিপর্যয়ের করুণ বিবরণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষের দিকে ছিল। সেই ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে আমেরিকান সেনাসদস্যদের মধ্যে ক্যানসাসে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে ব্যাপক আক্রমণ হয়েছিল এবং সারা পৃথিবীর কোনো দেশই মুক্তি পায়নি তার ছোবল থেকে। স্প্যানিশ ফ্লু্ল নামের সেই মহামারিতে পরের দুই বছরে পৃথিবীব্যাপী মানুষ মারা গেছে প্রায় ছয় কোটি। ইতিহাস বলছে, কানাডায় মারা যায় ৫৫ হাজারের ওপর; টরন্টো শহরে মারা গিয়েছিল এক হাজার ২০০ জন (টরন্টোর জনসংখ্যাই ছিল তখন পাঁচ লাখেরও কম)। আমেরিকাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ছয় লাখ ৭৫ হাজার। শুধু নিউইয়র্কেই সংখ্যাটি ছিল ১৯ হাজার (যদিও কভিড-১৯-এ এই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে এবার, তবে জনসংখ্যা এখন কয়েক গুণ)। ভারতবর্ষ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যার তেমন হিসাবই ছিল না তখন। তাই মৃত্যুর সংখ্যাও সঠিক জানা যায়নি। উল্লেখ করা যেতে পারে, স্প্যানিশ ফ্লুর প্রথম আক্রমণ এসেছিল ১৯১৮ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯১৯ সালে। কোনো কোনো জায়গায় তৃতীয়বারও এসেছিল ১৯২০ সালে। অর্থাৎ গ্রাফে দেখা যায়, তিন দফায় আক্রমণ শীর্ষ কোন বিন্দুতে পৌঁছে পরে ফ্ল্যাট হয়েছিল।
ধারণা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক মাসে কভিড-১৯-এর জীবনহানি গ্রাফ শীর্ষস্থান থেকে ক্রমে সীমিত হয়ে ধীরে সমান্তরাল রেখায় নেমে আসবে বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। অভিজ্ঞতার আলোকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর মতো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তাই পৃথিবীব্যাপী প্রথম মহামারি স্প্যানিশ ফ্লুর ইতিহাস আজ প্রণিধানযোগ্য।
স্প্যানিশ ফ্লুর ইতিহাসের আলোকে জনস্বাস্থ্যসেবা ও নীতিনির্ধারকদের আজ অবশ্যই কভিড-১৯-এর গতিপ্রকৃতি অনুসরণ করে সংক্রমণ রহিত হয়ে এলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করার পরিকল্পনা মাথায় রেখে এগোনো চাই। বাস্তবিকপক্ষে গ্রহণযোগ্য ভ্যাকসিন সুলভ না হওয়া অবধি আমরা যেন মাস্ক পরা, ঘরে ফিরে হাত ধোয়া এবং যথাসম্ভব সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা দৈনন্দিন জীবনে অভ্যাসে পরিণত করি। এ ব্যাপারে যে কোনো অবহেলা বা অসতর্কতা নিজের ও পরিবারের সবার জন্য বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ হবে। জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত যে কোনো ব্যাধির প্রাদুর্ভাব কখনও কোনো দেশের গোপন করাটা গ্রহণযোগ্য নয় এবং আক্রান্ত ও মৃতের পরিসংখ্যানে যে কোনো কৈফিয়তে ভুল সংবাদ পরিবেশনা বিশ্ববাসীর জন্য বিপদের ছায়া, ঘাতক ব্যাধি ভাইরাসের শামিল। আজ স্পষ্ট, স্প্যানিশ ফ্লুর করুণ ঘটনাবলির পর্যবেক্ষণ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার এখনই সময়।
কভিড-১৯ মহামারি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সংস্কৃতি, ধর্ম, কর্মক্ষেত্র, আর্থিক সঙ্গতি, ক্ষমতা বা খ্যাতি নির্বিশেষে আমরা আদতে সবাই সমান, সবাই মানুষ। করোনা রাজপ্রাসাদ থেকে রাস্তার নিঃস্ব মানুষ, ধর্ম, বর্ণ, দেশ ও জাতি সবাইকে নিরপেক্ষ বিবেচনায় নিয়েছে তার আক্রমণে। আমরাও কোনো প্রকার ক্ষমতা বা শ্রেষ্ঠত্বের দাবি না করে যেন আচার-আচরণে প্রতিপত্তি না দেখিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কি সামাজিক বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে সব মানুষকে সাম্যের বিবেচনায় রাখি। তবেই এ বিশ্বের মঙ্গল হবে, মনুষ্য সমাজ সুন্দর ও শান্ত হবে। আজ সবাইকে ভাবতে হবে, সুস্বাস্থ্য রক্ষা করা কতটা মহার্ঘ্য বা মূল্যবান। কৃত্রিম শিল্পজাত নিম্নমানের খাবার, কলুষিত রাসায়নিক পানীয় পান অসুস্থতা বা পীড়াকে আমন্ত্রণ জানায়। আজকাল একটি কথা শোনা যায়, যার ইমিউন সিস্টেম ভালো, তাকে করোনা সহজে কাবু করতে পারে না। তাই সবার ইমিউন শক্তিশালী করার লক্ষ্যে যা করণীয়, তার গুরুত্ব মনে রাখা বাঞ্ছনীয়।
ধৈর্য ও মনোবল হারিয়ে ম্রিয়মাণ হলে চলবে না; বরং আতঙ্ক বা উদ্বেগ না করে সংকট মোকাবিলায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকা চাই। বুঝতে হবে, এমন বৈশ্বিক বিপর্যয় আগেও ঘটেছে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। আজ কঠিন পরিচয়ের দিন এসেছে, নির্ভীক হয়ে সংশয় ত্যাগ করে এগোতে হবে। এ মহাবিশ্বে মানব জাতির জীবন প্রান্তভাগে এসে ঠেকেনি। মনোবল হারিয়ে ফেললে করোনাকে জয় করার চেয়ে অনিষ্টের আশঙ্কা বেশি।
এখন নতুন পরিপ্রেক্ষিতে জীবন শুরু করা চাই। সময় এসেছে উপলব্ধি করা ও প্রতিফলন দেখার। ভুলভ্রান্তি থেকে অনিবার্যভাবে শিক্ষা নিতে হবে। একই বৃত্তে ঘুরেফিরে শিখব-জানব, একে অপরের সহায়তায় থাকব, এ বিশ্ব চলমান থাকবে। আজ জেনে গেছি, এই ভূমি, মাটি, জল, আলো, বাতাস ও বন কলুষিত করা হয়েছে; প্রকৃতিতে তার প্রতিঘাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একটু চোখ মেলে তাকালেই দেখি, কতটা অরণ্য বিনাশ হয়েছে, কত দ্রুত টয়লেটরোল সেলফ থেকে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, আজ সবাই পীড়িত, কারণ পরিবেশকে রুগ্ণ করা হয়েছে, তাই প্রকৃতি রুষ্ট ও রুক্ষ।
করোনা সংক্রমণ ও তার গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা সরকারের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তহীনতা কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অনেক দেশে সরকারপ্রধানদের অহম বা নির্লিপ্ততা জাতিকে দুর্ভাগ্যজনক অবস্থায় ফেলেছে। আবার অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছিল বলে সংক্রমণ তেমন বিস্তার লাভ করেনি। ঘটনাবলির অন্তর্গত কাহিনি থেকে অবশ্যই সবার শিক্ষা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক- 'সময়োচিত সঠিক সিদ্ধান্তের কোনো বিকল্প হয় না।'
কানাডা প্রবাসী প্রকৌশলী
- বিষয় :
- কভিড-১৯ মোকাবিলা