ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সমকালীন প্রসঙ্গ

করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ 

করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ 

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১৬:০৪

চীনের উহান শহর থেকে প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণ-বিস্তারের প্রাদুর্ভাব পুরো বিশ্বকে অব্যাহত বিপন্ন করে তুলেছে। উন্নত-অনুন্নত ও ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে পৃথিবী নামক এই গ্রহে প্রতিটি দেশ-অঞ্চলে এই সংক্রমণের প্রসারমানতা এবং প্রাণ সংহারের পরিসংখ্যান বিরল অধ্যায় রচনা করেছে। সম্প্রতি করোনায় দেশে প্রাণহানির সংখ্যা চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে। আগামী শীত মৌসুমে দেশে এই সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গের আঘাত সম্পর্কে নতুন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। 
চলতি মাসে এই সংক্রমণের বিস্তার কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে উপনীত হওয়ার বিবেচনায় অর্থনৈতিক চাকা সচল করার লক্ষ্যে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা উন্মুক্ত করা হয়েছে। গত ৩১ আগস্ট থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘোষিত সাধারণ ছুটির শিথিল প্রক্রিয়ায় নিয়মিত কার্যক্রমে ফিরে আসার পরিক্রমা প্রশস্ততা লাভ করেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা প্রতিপালনে জনসচেতনতার প্রচণ্ড ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। করোনায় প্রতিদিনের মৃত্যুহার স্বস্তির চৌহদ্দি নির্মাণ করতে অপারগ। এরই মধ্যে ইতালি, ফ্রান্সসহ উন্নত বিশ্বে অনেক দেশে করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বিশ্বের সব নাগরিকের মতো ভ্যাকসিনসহ নানাবিধ উপকরণ আবিস্কার করোনা প্রতিরোধ এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে এটি জয় করার সম্ভাবনা আমাদেরও প্রাণিত করেছে। 
কিন্তু দ্বিতীয় তরঙ্গের অনাদৃত ভীতি কেন জানি আমাদের আনন্দ উপভোগের যাত্রাকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে। করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সংশ্নিষ্ট ব্যক্তি-সংস্থার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এখন থেকেই নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য। এখনও দেশে সংক্রমণের হার প্রায় ১২-১৪ এবং মৃত্যুর হার ১.৩৯ শতাংশ। কভিড-১৯ এর কারণে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্বের সব স্তরের শিশু-কিশোর। ইউনিসেফ সূত্রমতে, ৮০ মিলিয়নেরও বেশি শিশু চরম দারিদ্র্যের সম্মুখীন, ১.৬ বিলিয়ন শিশু স্কুলের বাইরে রয়েছে এবং এক বছরের কম বয়সী ৮০ মিলিয়ন শিশু জীবন রক্ষাকারী ভ্যাকসিন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এরই মধ্যে ক্ষুধার্ত শিশুর সংখ্যা ৩৬ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। দ্রুততার সঙ্গে সম্ভাব্য সংকট উত্তরণে মনন ও সৃজনশীল চিন্তাভাবনার সমন্বয়ে নতুন উদ্ভাবনী পন্থায় কর্মকৌশলের দৃশ্যমান কার্যকর বাস্তবায়নে সময় ক্ষেপণের কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। 
একদিকে করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের পূর্বাভাস এবং অন্যদিকে এর অদমনীয় বিস্তার প্রতিকূলে সংক্রমণ মুক্তির লক্ষ্যে ভ্যাকসিন আবিস্কার ও বিক্রয়, উন্নত বিশ্বের কতিপয় দেশের ক্রমবর্ধমান স্নায়ুযুদ্ধ, স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সরঞ্জামাদির বাণিজ্যিকীকরণের অশুভ-অসম প্রতিযোগিতার লুম্পেন দৃশ্যপটে বিশ্ববাসী চরম উদ্বিগ্ন। আর্থসামাজিক ও সামগ্রিক মানব-প্রতিবেশের ওপর এর নিদারুণ বৈরী প্রভাব জগজ্জনে অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত পরবাদ সুদৃঢ় করছে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে প্রায়োগিক কোনো পন্থা এখনও সমধিক সুস্পষ্ট নয়। চলমান দরিদ্রতা, ক্ষুধা ও কর্মহীনতার নির্মম মহামারির করুণ পদধ্বনি মানব-সংকট সমাধানে অতিশয় অবিশ্বাস ও অনাস্থার প্রেক্ষিত রচনা করে চলেছে। 
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল সূত্র জানিয়েছে যে, এখন থেকেই যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হলে বছরের শেষ পর্যায়ে বিশ্বে দিনে ১২ হাজারের বেশি মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে পারে। সবচেয়ে বেশি সংকটাপন্ন ও চরম ক্ষুধার হটস্পট হিসেবে ১০টি দেশ অনুমিত হয়েছে। ইয়েমেন, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, আফগানিস্তান, ভেনেজুয়েলা, পশ্চিম আফ্রিকান সাহেল, ইথিওপিয়া, সুদান, সাউথ সুদান, সিরিয়া ও হাইতি অন্যতম। এশিয়া, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না হলেও এতদঞ্চলে কর্মচ্যুত জনগোষ্ঠীর হাহাকার পুরো অঞ্চলকে অতিশয় অস্থিতিশীল করে তুলবে- নিঃসন্দেহে তা বলা যায়। 

অতিসম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন অনুসারে, বছরের শেষ দিকে বিশ্বে প্রায় দশ কোটি মানুষ চরম দরিদ্রতার নিষ্ঠুর শিকারে নিপতিত হবে। বিভিন্ন বৈশ্বিক এবং দেশীয় প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অচিরেই বিশ্বে বিশ-পঁচিশ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। এর মধ্যে আমাদের এই মহাদেশ ও উপমহাদেশে সাড়ে বারো কোটি লোকের কর্মহীনতার অশনিসংকেতও প্রক্ষেপিত হচ্ছে। করোনার বিপর্যস্ত অতিক্রান্তকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিরোধ-বিচ্ছেদ-সংঘাত এবং উপার্জন ও জীবন নির্বাহের কঠোর বৈষম্য নতুন বৈশ্বিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে দুঃসাধ্য দাবানলের বিপরীতে ভারত-চীনসহ অনেক দেশে ভয়াবহ বন্যার নতুন ধ্বংসযজ্ঞ প্রকীর্ণ হয়েছে। বদ্বীপ খ্যাত ক্ষুদ্র আয়তনের আমাদের দেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব বিরাজমান বিপন্নতায় নতুন মাত্রিকতা যোগ করেছে। 
সম্প্রতি বিআইজিডি ও পিপিআরসির যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে করোনাকালে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যের হার ৪২ শতাংশ। আয়মূলক কর্মহীন পরিবারের সংখ্যা ১৭ শতাংশ। ব্যাপক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের কর্মহীনতার হার সবচেয়ে বেশি। জুন ২০২০ নাগাদ দৈনিক তিন বেলা খেতে না পারার সংখ্যা বস্তি এলাকায় ১১ শতাংশ, গ্রামে ৬ শতাংশ এবং ঢাকায় ১৫ শতাংশ পরিবার চিহ্নিত হয়েছে। শহর-নগর দারিদ্র্যের গ্রামে যাত্রার নতুন পরিসংখ্যান তথা ঢাকায় ১৬ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে ৮ শতাংশ বস্তিবাসীর অন্য জেলায় স্থানান্তর দারিদ্র্যের প্রকৃতি-পরিধি ও বিস্তারের প্রচলিত চিত্র পাল্টে দিয়েছে। ৭৮ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশির স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বৈশ্বিক কর্মহীনতা ও আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতির জানান দিচ্ছে।
দেশ ও দেশবাসীর জন্য অনন্যসুন্দর আশা সঞ্চারের বার্তা হচ্ছে, গার্মেন্ট শিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য নতুন উদ্যমে কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে। নতুন করে পর্যাপ্ত পরিমাণ তৈরি পোশাকের কার্যাদেশ অধিকতর প্রণোদনার সঞ্চার করেছে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলারের অধিক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অপরিমেয় আশায় দেশকে উদ্ভাসিত করছে। এডিবির প্রাক্কলন অনুসারে চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬.৮ শতাংশ। 'বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০'-এর যথার্থ প্রণয়ন, কর্মকৌশল নির্ধারণ ও যুক্তিনির্ভর বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হিসেবে এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রাভাতিক কমিটি গঠন যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। 
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসন সংকট প্রকট থেকে প্রকটতর ও প্রবাসীদের জীবনপ্রবাহ যন্ত্রণাবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় অমানবিকতার নতুন স্বরূপ বিরচিত হচ্ছে। নিকট অতীতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আয়োজিত সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল গ্লোবাল শীর্ষ সম্মেলনে দেশের প্রধানমন্ত্রী এই হৃদয়বিদারক অভিবাসন সংকট মোকাবিলায় বিশ্বনেতাদের ঐক্যবদ্ধ জোরালো প্রয়াস আহ্বান করেছেন। এই সামিটে অতি চমৎকারভাবে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দিয়ে বিশ্বনেতৃত্বের উঁচু মার্গের অবস্থানে নিজেকে এবং জাতিকে মহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে সক্ষমও হয়েছেন। অসীম সাহসিকতায় অসাধারণ প্রজ্ঞায় উত্থাপিত করেছেন- 'এই সংকটের সময় বিদেশের বাজারগুলোতে অভিবাসী কর্মীদের চাকরি বজায় রাখতে হবে, প্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ এবং অন্যান্য সুবিধা পুরোপুরি প্রদান করার পাশাপাশি তাদের সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে এবং মহামারির পরে অর্থনীতি ফের সক্রিয় করার জন্য এই শ্রমিকদের নিয়োগ দিতে হবে।' প্রস্তাবগুলো শুধু বিশ্বনেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেনি, বিশ্বের সব দুর্দশাগ্রস্ত এবং অসহায় শ্রমিকের মনোবল বৃদ্ধিতে অভূতপূর্ব অনুপ্রেরণায় ঋদ্ধ হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার নিধন করে যথার্থ ব্যবহার-উপযোগী কর্মসংস্থান, পাটকল আধুনিকায়ন এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যৌক্তিক ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন যন্ত্রকৌশল বা সরঞ্জামাদিসমৃদ্ধ শিল্পকারখানা স্থাপন, কৃষি উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সর্বোপরি সমৃদ্ধ মানবসম্পদ উৎপাদনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ব্যাহত হলে কর্মহীনতা-দরিদ্রতার কশাঘাতে জনরোষ সৃষ্টি এবং অরাজক পরিবেশ তৈরির সমূহ পদধ্বনি বিঘোষিত হতে পারে। যুক্ত হতে পারে ব্যতিক্রমধর্মী অপরাধ কর্মযজ্ঞ। হত্যা-আত্মহত্যা-ধর্ষণ-চুরি-রাহাজানি-ছিনতাই-প্রতারণা-শঠতা-মাদক সেবন-কিশোর গ্যাং অপরাধ-জঙ্গি তৎপরতার উন্মাদনা এবং নতুন অপকৌশল অপকর্মের মাধ্যমে সৃষ্ট অপরাধকর্ম করোনা অতিমারির চেয়েও দুঃসহ মহামারির আকার ধারণ করতে পারে। দেশকে বিপন্ন করার সমূহ সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে কঠিন এবং কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে সামগ্রিক পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ বহুলাংশে দুরূহ হওয়ার বাস্তবসম্মত কারণ রয়েছে।
সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×